শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪

|

বৈশাখ ৫ ১৪৩১

Advertisement
Narayanganj Post :: নারায়ণগঞ্জ পোস্ট

যে কারণে যেভাবে খুন হন মা-ছেলে

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

প্রকাশিত: ০৬:০৯, ১৩ জুলাই ২০২২

আপডেট: ০৬:১০, ১৩ জুলাই ২০২২

যে কারণে যেভাবে খুন হন মা-ছেলে

সাদিকুর রহমান সাদি

একটি গার্মেন্ট প্রতিষ্ঠানে ফিটারম্যান পদে চাকরি করা সাদিকুর রহমান সাদি এলাকায় বেশ ভদ্র বলেই সুপরিচিত ছিলেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজি সাদি কখন যে আইপিএল জুয়ায় আসক্ত হয়ে বড় অংকের ঋণগ্রস্ত হয়েছিল সেই কথা বুঝতেই পারেননি কেউ। সেই ঋণের টাকা শোধের জন্য মানসিকভাবে চরম হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল সে। সেই হতাশা থেকে বিপথগামী হয়ে উঠা ‘পাগলপ্রায়’ সাদি ধার চাইতে গিয়ে খুন করেন তার ভাবি সম্পর্কীয় রাজিয়া সুলতানা আর শিশুসন্তান তালহাকে। 

গত ১০ জুলাই নারায়ণগঞ্জের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কাওসার আলমের আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়ে সাদিকুর রহমান সাদি আদ্যোপান্ত বর্ণনা দিয়েছেন সেই খুনের ঘটনার। একপর্যায়ে অনুশোচনায় চিৎকার করে কাঁদতে কাদঁতে ধরেছেন ম্যাজিস্ট্রেটের পা। নিজের জবানবন্দি দেওয়ার পুরোটা সময়ই কেঁদেছেন সাদি; কিন্তু তার এ অনুশোচনা ফিরিয়ে দিতে পারবে না খুন হওয়া ২টি প্রাণ। 

নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারের ব্রাহ্মণদী ইউনিয়নের উজান গোবিন্দি এলাকায় গত ২ জুলাই গভীর রাতে ঘটে যাওয়া এই লোমহর্ষক জোড়া খুনের ঘটনায় জড়িত সাদিকে গ্রেফতারের পর সোমবার এ তথ্য জানিয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। 

এর আগে গত ৯ জুলাই তাকে নিজের বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয়। উদ্ধার করা হয় লুট করে নেওয়া স্বর্ণালঙ্কারও। সোমবার ধানমন্ডী পিবিআই প্রধান কার্যালয়ে এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেছেন পিবিআই প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি বনজ কুমার মজুমদার।

এদিকে চাঞ্চল্যকর এই জোড়া খুনের ক্লু মিলেছে ওই বাড়ির পেছনে থাকা একটি সুপারি গাছ থেকে। গাছে লেগে থাকা মাটি দেখে সন্দেহ হওয়ায় এর সূত্র ধরে তদন্তে বের হয়ে আসে চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যের ঘটনা। গত ৩ জুলাই ভোরে ঘরের ভেতরে কাকুলি ও তার ছেলের রক্তাক্ত লাশ পাওয়া যায়। এ ঘটনায় আড়াইহাজার থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন স্বজনরা। ঘটনার পর থেকেই ছায়া তদন্ত শুরু করে পিবিআই নারায়ণগঞ্জ এবং গত ৯ জুলাই মামলার দায়িত্ব নেওয়ার দিনই পিবিআই নারায়ণগঞ্জ ইউনিটের ইনচার্জ পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম, মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই শাকিল হোসেন ও এএসআই মাজহারুল ইসলাম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। 

একপর্যায়ে তারা মৃতের বসতঘরের পেছনের দেয়ালের সঙ্গে লাগানো সুপারি গাছের গোড়া থেকে আনুমানিক দুই ফুট ওপরে এক জায়গায় সদ্য মাটি লাগানো দেখতে পান। তদন্তকারী দল লক্ষ্য করে গাছে কোনো সুপারি নেই। বিষয়টি তদন্ত দলের মনে সন্দেহের সৃষ্টি করে। পিবিআই স্থানীয় সোর্সের সঙ্গে আলোচনা করে জানতে পারে, বাড়ির পেছনে ফ্রি ওয়াইফাই সংযোগ থাকায় কাকুলির ভাসুরের কিশোর ছেলে অজিদ কাজীসহ কয়েকজন সেখানে বসে মোবাইলে নেট ব্রাউজ করে। 

এরপর অজিদকে জিজ্ঞাসাবাদে সে জানায়, ২ জুলাই রাত আনুমানিক সাড়ে ১০টার দিকে সে মৃতের বাড়ির পেছনের দেয়াল ঘেঁষে বসে মোবাইল ফোনে গেম খেলার সময় হঠাৎ তালহার চিৎকার শুনতে পায়। তখন সে বাথরুমে কারও হাত ধোয়ার শব্দও শুনতে পায়। সন্দেহ হলে সে বাড়ির পেছনের দেয়ালের পাশে থাকা সুপারি গাছ বেয়ে উঠে বাথরুমের ভেনটিলেটর দিয়ে উঁকি দিয়ে প্রতিবেশী যুবক সাদিকে বাথরুমে দেখতে পায়। সাদি বের হয়ে যাওয়ার সময় ঘরের পেছনে অজিদকে বসে থাকতে দেখে। অজিদ ভেবে নেয়, তার চাচির (কাকুলি) সঙ্গে সাদির অবৈধ সম্পর্ক আছে। পরদিন সকালে হত্যার ঘটনা প্রকাশ হওয়ার পর সাদিকুর তার (অজিদ) সঙ্গে দেখা করে বলেন, ‘আমার কথা কাউকে বললে তোরে জানে মেরে ফেলব’। এই ভয়ে সে ঘটনা চেপে যায়।

এসব তথ্য পাওয়ামাত্রই পিবিআই সাদিকে তার বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে। ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদে তিনি জোড়া খুনের দায় স্বীকার করে বিস্তারিত বর্ণনা দেন। 

তিনি জানান, তিনি স্থানীয় সাকিব নিটওয়্যারে ফিটারম্যান পদে চাকরি করেন। বেশ কিছু টাকা ধার করে আইপিএলে জুয়া খেলে সব হারান। পরে পাওনাদারদের চাপে তার মাথা নষ্ট হয়ে যায়। তখন তিনি পাগলের মতো টাকা খুঁজতে থাকেন। এর মধ্যে তিনি জানতে পারেন, প্রতিবেশী কাকুলির কাছে বেশ টাকা-পয়সা আছে এবং তার ঘরে অনেক সোনাদানা আছে। তিনি জানতেন শিশুসন্তান ছাড়া ওই ঘরে আর কেউ থাকেন না। ভুক্তভোগীর স্বামী দুই বছর আগে মারা যান। ২ জুলাই রাতে সাদি নিহত কাকুলির বাসায় যান। প্রথমে বলেন, তার মা ইলেকট্রিক ব্লেন্ডার ধার নেওয়ার জন্য পাঠিয়েছেন। 

এরপর ঘরে ঢুকে তার পা ধরে ১০ হাজার টাকা ধার চান। কিন্তু ভুক্তভোগী জানান, তার কাছে কোনো টাকা নেই। এরপরও অনেক জোরাজুরি করলে তিনি আলমারি খুলে বলেন, ‘দেখ, আলমারিতে শুধু ১০০ টাকা আছে। আর কোনো টাকা নাই’। এ সময় আলমারিতে কিছু স্বর্ণের জিনিসপত্র দেখতে পান সাদি। তখন স্বর্ণ লুটের লোভে তিনি কাকলিকে চেয়ারে বসিয়ে ওড়না দিয়ে গলায় ফাঁস দেন। এরপর বিছানার পাশে রাখা ইস্ত্রি দিয়ে তার মাথায় জোরে আঘাত করেন। শেষে রান্নাঘর থেকে বটি এনে গলা কেটে মৃত্যু নিশ্চিত করেন। 

এরপর আলমারি খুলে স্বর্ণালঙ্কার (দুটি স্বর্ণের আংটি, দুটি স্বর্ণের চেইন, এক জোড়া কানের দুল) নিয়ে নেন। চলে যাওয়ার সময় তিনি পাশের ঘরে খাটের ওপর ঘুমন্ত তালহাকেও গলা কেটে হত্যা করেন। তখন তালহা চিৎকার করে উঠে, যা অজিদ শুনতে পায়।

পিবিআই জানায়, রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে সাদির দেওয়া তথ্যমতে, তার শোবার ঘরের বিছানার তোশকের নিচ এবং স্বর্ণ ব্যবসায়ী গোপালের কাছ থেকে লুণ্ঠিত স্বর্ণ উদ্ধার করা হয়। এছাড়া আলামত হিসেবে হত্যায় ব্যবহৃত লোহার বঁটি, ইলেকট্রিক ইস্ত্রি, রক্তমাখা ওড়না জব্দ করা হয়।