শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪

|

বৈশাখ ৫ ১৪৩১

Advertisement
Narayanganj Post :: নারায়ণগঞ্জ পোস্ট

চাকরি দেওয়ার কথা বলে নারীকে সৌদি আরবে ‘বিক্রি’, চলতো নৃশংস নির্যাতন

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

প্রকাশিত: ০৩:০৭, ১ ডিসেম্বর ২০২২

আপডেট: ০৩:০৮, ১ ডিসেম্বর ২০২২

চাকরি দেওয়ার কথা বলে নারীকে সৌদি আরবে ‘বিক্রি’, চলতো নৃশংস নির্যাতন

ফাইল ছবি

‘সৌদি আরবে চাকরি দেওয়ার কথা বলে নিয়ে আমাকে অন্য অফিসে বিক্রি করে দেয় তারা। এরপর এক বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজে পাঠায়। সেখানে শুরু হয় অমানবিক নির্যাতন। এজেন্সির অফিসে অভিযোগ করেও প্রতিকার পাইনি, উল্টো নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে। একদিন খেলে অপর দিন না খেয়ে কাটাতে হয়েছে। দেশের বাড়িতে স্বজনদের কাছে জানালে নির্যাতনের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেওয়া হতো। দেশে ফিরে আসতে চাইলে আরও মারধর করতো। আমার মতো অনেক নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছে। কিন্তু ভয়ে কেউ তাদের বিরুদ্ধে মুখ খুলতো না।’ 

কথাগুলো বলছিলেন সৌদি আরবে নির্যাতনের শিকার নারায়ণগঞ্জের এক নারী (৩৪)। নারায়ণগঞ্জের সদর উপজেলায় স্বামী-সন্তান নিয়ে বসবাস করতেন। সংসারে অভাব-অনটন লেগেই থাকতো। সচ্ছলতা ফেরাতে ও ঋণ পরিশোধ করতে তিনি সৌদি আরবে যান। সেখানে গিয়ে তার ওপর শুরু হয় নির্যাতন। অবশেষে বহু কষ্টে গত ২২ নভেম্বর দেশে ফিরে আসেন।

তিনি বলেন, ‘আমার মেয়ের বিয়ে দিতে গিয়ে অনেক টাকা দেনা হয়ে যায়। সেই টাকা পরিশোধ করতে ও সংসারে সচ্ছলতা ফেরানোর স্বপ্ন দেখিয়ে দালাল মালেক ৩০ হাজার টাকা বেতনে গৃহকর্মীর চাকরি দেওয়ার কথা বলে। এরপর সাইফুল ইসলাম ও বাবুর সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। পরে তারা আমাকে সৌদি আরবে পাঠায়। তবে চাকরি দেওয়ার কথা বলে ওই দেশে নিয়ে আমাকে অন্য অফিসে বিক্রি করে দেয়। রিয়াদ শহরের আরেকটি অফিসে আমাদের পাসপোর্ট দিয়ে বিক্রি করে দেয়। সেখান থেকে তাদের লোকের মাধ্যমে প্রায় আট ঘণ্টার দূরত্বের পথ অতিক্রম করে একটি বাড়িতে নিয়ে যায় এবং গৃহকর্মীর কাজ দেওয়া হয়।’

ভুক্তভোগী জানান, এক মাস ১০ দিন পর বেতনের টাকার ৮২০ রিয়াল দেয়। তবে মাসিক ১ হাজার রিয়েল দেওয়ার কথা ছিল। আর বেতনের টাকা দেওয়ার সময় তার মুখে ছুড়ে মারে। এরপর থেকে মারধর শুরু হয়। কেন মারধর করতো তা তিনি জানতেন না। তাদের দেশের ভাষা তো বুঝতাম না। এজেন্সির লোকদের বিষয়টি জানান এবং কাজের স্থান বদল করে দিতে বলেন। এরপরও প্রায় এক সপ্তাহ সেখানে থাকার পর তাকে এজেন্সির অফিসে নেওয়া হয়।

এর মধ্যে দেশে স্বজনদের বিষয়টি জানালে তারা এজেন্সির মালিক সাইফুলের সঙ্গে কথা বলেন। সাইফুলের সঙ্গে সাক্ষাত হলে তার কথামতো রুবেলের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বললেন। রুবেল তাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে ৩ লাখ ২০ হাজার টাকা দাবি করেন। এদিকে অপর দুই দালাল মালেক ও বাবু ভুক্তভোগীকে ফোন করে জানান, ‘আপনাকে যে বাড়ি থেকে আনা হয়েছে সেখানে নিয়ে যাওয়া হবে, আপনি বেঁচে থাকেন-মরে যান তা দেখার বিষয় না।’ 

এদিকে এজেন্সির অফিসের যেই কর্মকর্তার অধীনে ছিলেন, সে অনেক মারধর করেছে, যাতে তাদের কথামতো ওই বাড়িতে ফিরে যান ভুক্তভোগী। বড় জগ ছুড়ে মেরে নাক ফাটিয়ে দিয়েছে। পেটে সিজারের সেলাইয়ের অংশে লাথি মেরেছে, এতে অনেক সমস্যা হয়েছে। পরে দেশ থেকে নিয়ে যাওয়া ওষুধ সেবন করে কিছুটা সুস্থ হয়ে আবারও সেই আগের বাড়িতে জোর করে দিয়ে যায়। তখন ভুক্তিভোগী বলেন, ‘আমি ওই বাড়িতে যাবো না, তখন এজেন্সির কর্মকর্তারা বলে, তুই মরে যা অথবা বেঁচে থাক তা দেখার বিষয় না। দুই বছর সেখানে থাকতে হবে। এ কথা বলে আমাকে সেই বাড়িতে জোর করে দিয়ে আসে। সেখানে আত্মহত্যার ভয় দেখালে তারা আমাকে আবারও এজেন্সিতে ফেরত পাঠায়।’ 

ভাইয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশের পুলিশ-প্রশাসনকে লিখিত অভিযোগ দিয়ে নির্যাতনের কথা জানান ভুক্তভোগী। এই অভিযোগ তারা উঠিয়ে নিতে বলে আবারও মারধর করে। এভাবে দিনের পর দিন নির্যাতন করেছে।ণ আর পাঁচ মাসের বেশি সময় সেখানে ছিলেন তিনি। অথচ প্রথম মাসের ৮২০ রিয়াল দিয়েছে, এরপর আর কোনও বেতন দেয়নি। শারীরিক নির্যাতনের পাশাপাশি খাওয়ার কষ্ট দিয়েছে। দিনের পর দিন না খেয়ে থেকেছেন। যেটুকু খাবার দেওয়া হতো তা সপ্তাহের তিন দিন অতিবাহিত হলে ফুরিয়ে যেতো, এ কারণে কোনও দিন খেতে পেরেছেন কখনও পারেননি। এ সময় অফিসের অন্য নারীদের কাছ থেকে ২-১ রিয়াল পেলে কখনো খেতেন, না পেলে অনাহারে দিন কাটাতেন।

ভুক্তভোগী বলেন, ‘আমার মতো আরও অনেক নারী সেখানে ছিল, সবার অবস্থা এক। কেউ ভয়ে মুখ খুলতো না। আমি তাদের বিচার চাই।’ 

গত ২২ নভেম্বর বাংলাদেশে পৌঁছান ভুক্তভোগী। ২৪ নভেম্বর বাদী হয়ে চার জনকে আসামি করে হাতিরঝিল থানায় মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে মামলা করেন। মামলার পর থেকে ওই নারীর স্বজনদের ওপর চাপ প্রয়োগসহ ভয়ভীতি প্রদর্শন করা হচ্ছে বলে জানান।

মামলার আসামি হলো- রাজধানীর ভাটারা থানার সাইদনগর এলাকার এম এস সাসকো ট্রেড লিমিটেডের মালিক সাইফুল ইসলাম (৪৫), নোয়াখালীর সোনাইমুড়ি থানার কালিকাপুর এলাকার হাজী আবুল হাসেমের ছেলে মো. রুবেল (৪২)। তিনি রাজধানীর রমনা থানার কাকরাইল এলাকায় বসবাস করতেন। অপর আসামি মো. মালেক। তিনি নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে বসবাস করেন। আরেকজন রাজধানীর ভাটারা থানার সাইদনগর এলাকার বাবু (৪২)। 

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও হাতিরঝিল থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) আসআদ বিন আব্দুল কাদির বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এই ঘটনায় আসামি রুবেলকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সে বর্তমানে জেলহাজতে রয়েছে। রুবেলসহ বাকি আসামিরা যোগসাজশে ওই নারীকে চাকরি দেওয়ার কথা বলে বিদেশে পাচার করেছে। প্রকৃত অর্থে যে চাকরি দেওয়ার কথা ছিল সেই চাকরি তাকে দেয়নি। উল্টো ওখানে গিয়ে তিনি নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তার ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়েছে।’