মঙ্গলবার, ০১ জুলাই ২০২৫

|

আষাঢ় ১৬ ১৪৩২

Advertisement
Narayanganj Post :: নারায়ণগঞ্জ পোস্ট

আ.লীগের প্রভাবে প্রশাসন মিডিয়াকে থোয়াই কেয়ার করতেন তেল মাফিয়া টুটুল

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

প্রকাশিত: ১৫:১৮, ১ জুলাই ২০২৫

আ.লীগের প্রভাবে প্রশাসন মিডিয়াকে থোয়াই কেয়ার করতেন তেল মাফিয়া টুটুল

ফাইল ছবি

নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় আলোচিত ব্রাজিল বাড়ির মালিক জয়নাল আবেদীন টুটুল। রাষ্ট্রয়াত্ব তেল কোম্পানী যমুনা অয়েল কোম্পানীর ক্যান্টিন বয় থেকে আওয়ামী লীগের নেতাদের প্রভাবে ফতুল্লার তেল মাফিয়া হয়ে ওঠেন টুটুল। তেল চুরি সিন্ডিকেট পরিচালনা করায় তার নাম হয় তেল টুটুল।

আওয়ামী লীগের আমলে তেল চুরির সিন্ডিকেট থেকে হাজার কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন টুটুল। তার বিরুদ্ধে একাধিকবার প্রশাসনের কাছে অভিযোগ দেয়া হলেও তৎকালীন আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী এমপি শামীম ওসমানের প্রভাবে ড্যামকেয়ার ভাবে এলাকায় চলতেন টুটুল। পাঁচ বারের ফুটবল বিশ্বকাপ চ্যান্পিয়ন ব্রাজিলের পতাকার আদলে বাড়ি রং করে বিশ্বকাপের সময় আলোচনায় আসেন টুটুল।

ব্রাজিল বাড়ি থেকে গণমাধ্যমের অনুসন্ধানে টুটুলের আলাদিনের চেরাগ হাতে পাওয়ার মত হঠাৎ হাজার কোটি টাকার মালিক হওয়ার তথ্য উঠে আসে। এ নিয়ে একাধিক রিপোর্ট প্রকাশিত হলেও আওয়ামী লীগের আমলে বহাল তবিয়তে থেকেই তেল চুরির সিন্ডিকেট পরিচালনা করেছেন টুটুল। চুরির সিন্ডিকেটের টাকার ভাগ স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা থেকে শুরু করে এমপি মন্ত্রী পর্যন্ত।

জানা যায়, জয়নাল আবেদীন টুটুলের বাবা মো: রফিক একসময় ছিলেন ফতুল্লার পঞ্চবটিতে অবস্থিত রাষ্ট্রয়াত্ব তেল কোম্পানী যমুনা অয়েল কোম্পানীর সিকিউরিটি গার্ড। কর্তব্যপালনরত অবস্থায় তিনি মারা যাওয়ার পর তার পরিবারের একজন সদস্য হিসেবে টুটুল যুমনা তেল ডিপোতে কাজ পায়। তবে স্থায়ী কোন চাকরী নয়। অস্থায়ী ভিত্তিতে (নো ওয়ার্ক নো পে) ডিপোর ক্যান্টিন বয় হিসেবে। তার কাজ ছিল প্লেট ধোয়ার। বিনিময়ে দৈনিক ৫০ থেকে ৫৫ টাকা পেতেন। গ্রামের স্কুলে থ্রি-ফোর পর্যন্ত, তারপর ফাইভ-সিক্স নারায়ণগঞ্জের লেখা-পড়ার কথা জানিয়েছেন টুটুল।

ক্যান্টিন বয় থেকে এক সময় স্থায়ী চাকরী পেয়ে যান ডিপোর গ্রেজার (তেল মাপার অপারেটর) সেকশনে। তেল মাপার চাকরী পাওয়ার পর টুটুলকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ধীরে ধীরে তার ভাগ্যের চাকা খুলে যায়। অল্পদিনের মধ্যে তেল চুরির বিদ্যা রপ্ত করেন তিনি। প্রতিদিন হাজার হাজার লিটার তেল চুরির সিন্ডিকেটের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন টুটুল। যমুনা অয়েল কোম্পনীর নিয়ন্ত্রণ করা তিনজন কর্মকর্তা ও দুইজন সিবিএ নেতার সমন্বয়ে ওই সিন্ডিকেট। ওই সিন্ডিকেটের ইশারায় বদলী, পদায়ন থেকে শুরু করে সব কিছুই হত সেসময়।

যমুনা অয়েল কোম্পানীর সংশ্লিষ্টদের মতে, তেল চুরি সিন্ডিকেটের সাথে জড়িত এসকল গ্রেজারের প্রত্যেকের দৈনিক আয় কমপক্ষে ১ লাখ টাকা। কখনো কখনো মাসে এ টাকার অংক ছাড়িয়ে যেত কোটিতে।

জানা যায়, আওয়ামী লীগের আমলে তেল চুরির টাকায় ফতুল্লায় বিশাল মাফিয়া সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছিলেন টুটুল। এখনো বহাল এই টুটুল নিয়ন্ত্রণ করছেন যমুনা ডিপো। ওসমান পরিবারের ভয় দেখিয়ে এখনো রাজত্ব চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি।

বুড়িগঙ্গা হয়ে টুটুলের মাধ্যমে আসা অস্ত্র ব্যবহৃত হয় আন্দোলন দমাতে

নারায়ণগঞ্জে ছাত্র জনতার আন্দোলন দমনে অত্যাধুনিক সব অস্ত্র ব্যাবহার করেছিল শামীম ওসমান ও তার অনুসারীরা। স্বয়ংক্রিয় অত্যাধুনিক এসকল অস্ত্র সাধারণত পুলিশের কাছেও দেখা যায় না। রাইফেল ক্লাবের অস্ত্রের পাশাপাশি আন্দোলন দমন করতে শামীম ওসমান ও তার অনুসারীদের পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে নদী পথে অস্ত্র এনে দেন ফতুল্লার আলোচিত তেল মাফিয়া টুটুল ওরফে তেল টুটুল। এখনও অত্যাধুনিক এসকল অস্ত্রের ভান্ডার টুটুলের কাছেই সংরক্ষিত রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

জানা যায়, নদীপথে বিভিন্ন হাত বদল হয়ে জাহাজ ও ট্রলারে করে ফতুল্লার যমুনা ডিপোতে তেল আনা হয়। ডিপোর তেল চুরির পাশাপাশি এই পথেই চোরাই অন্যান্য অবৈধ মালামাল আনতেন টুটুল। জানা যায়, ছাত্র জনতার আন্দোলন চলাকালীন সময় শামীম ওসমানের নির্দেশে দেশের বাইরে থেকে তেল চুরির সিন্ডিকেটের সদস্যদের মাধ্যমে বিভিন্ন নদী দিয়ে বুড়িগঙ্গা নদী হয়ে অস্ত্রের বিশাল চালান ফতুল্লায় আনেন টুটুল।

২০২৪ সালের ১৯ জুলাই ফতুল্লা থেকে অস্ত্রের বিশাল চালান চাষাঢ়ায় নিয়ে আসেন টুটুল। পরবর্তীতে এই অস্ত্র নিয়ে শহরে তান্ডব চালায় শামীম ওসমান ও তার অনুসারীরা। শহরের নারায়ণগঞ্জ ক্লাবের সামনে থেকে গুলিবর্ষণ করতে করতে আন্দোলনকারীদের ধাওয়া দিয়ে ডিআইটি এলাকা পর্যন্ত যান শামীম ওসমান। এসময় চারিদিকে এলোপাতাড়ি গুলি ছুঁড়তে থাকেন শামীম ওসমান ও তার অনুসারীরা।

১৯ জুলাই বিকেলে প্রায় একই সময় নয়ামাটি এলাকায় বাড়ির ছাদে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান রিয়া গোপ। সেদিন দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শহরে কোন পুলিশ সদস্যরা ছিল না। শামীম ওসমানকে টুটুলের সরবরাহকৃত সেই অস্ত্রের গুলিতেই রিয়া গোপ নিহত হন বলে ধারণা অনেকের।

জানা যায়, সাধারণ অস্ত্রের রেঞ্জ এত বেশি হয় না। অত্যাধুনিক অস্ত্রের গুলির রেঞ্জ বেশি থাকে, এসকল অস্ত্রের গুলি অনেক দূর পর্যন্ত লক্ষ্য বস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম। ধারণা করা হয়, এমন অত্যাধুনিক অস্ত্রের গুলিতেই রিয়া গোপের মৃত্যু ঘটে। সেসময় সরকার কর্তৃক সবকিছু কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করায় ময়নাতদন্তের রিপোর্ট নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। যথাযথ রিপোর্ট পাওয়া গেলে এবিষয়ে আরও স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যেত।

পাঁচ আগষ্টের পর আওয়ামী লীগের শেল্টারে বেড়ে ওঠা তেল মাফিয়ার ব্রাজিল বাড়িতে হানা দেয়। এসময় তার বাড়িতে ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করে বিক্ষুব্ধ জনতা।

জানা যায়, পাঁচ আগষ্ট সরকার পতনের খবর পাওয়ার সাথে সাথে পরিবারের সদস্যদের পার্শ্ববর্তী একটি বাড়িতে লুকিয়ে রাখে টুটুল। তবে বাড়িতে আটকে পড়েন তিনি। স্থানীয় জনতা টুটুলের বাড়িতে হানা দিলে রাতে বাড়ির ছাদ থেকে রশি বেয়ে পাশের একটি বাড়ির ছাদে আশ্রয় নেন টুটুল। রাত পর্যন্ত সেখানেই থাকেন টুটুল। পরে রাতে গোপনে অন্যত্র পালিয়ে যান টুটুল।

এদিকে পাঁচ আগষ্টের পর স্থানীয় প্রভাবশালীদের সাথে সখ্যতা গড়ে তুলেছেন টুটুল। তাদের শেল্টারে পর্দার অন্তরালে থেকেই এখনও তেল চুরির সিন্ডিকেট পরিচালনা করছেন টুটুল। জানা গেছে, আন্দোলন দমন করতে দেশের বাইরে থেকে আনা অত্যাধুনিক এসকল অস্ত্রের মজুদ এখনও টুটুলের কাছে রয়েছে। পাশাপাশি বিদেশে পলাতক গডফাদারদের সাথেও নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন তেল টুটুল।