মঙ্গলবার, ২৪ জুন ২০২৫

|

আষাঢ় ৯ ১৪৩২

Advertisement
Narayanganj Post :: নারায়ণগঞ্জ পোস্ট

৫ আগস্ট লং মার্চে গিয়ে আর ফিরে আসেনি নারায়ণগঞ্জের মুন্না

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

প্রকাশিত: ১১:০৮, ২৪ জুন ২০২৫

৫ আগস্ট লং মার্চে গিয়ে আর ফিরে আসেনি নারায়ণগঞ্জের মুন্না

ফাইল ছবি

বিগত আওয়ামী লীগ সরকার পতনের এক দফা দাবিতে গত বছরের ৫ আগস্ট ঢাকার লং মার্চে গিয়ে আর ফিরে আসেননি সাব্বির হোসেন মুন্না (২৪) নামে নারায়ণগঞ্জের এক যুবক। জুলাই আগস্ট আন্দোলনের যোদ্ধা মুন্না বেঁচে আছেন নাকি শহীদ হয়েছেন এ নিয়ে অনিশ্চয়তায় রয়েছে তার পরিবার। এখনও মুন্নাকে বিভিন্ন স্থানে খু্ঁজে বেড়াচ্ছেন স্বজনরা। দীর্ঘ দশ মাস ধরে চোখের পানিতে বুক ভাসাচ্ছেন মুন্নার বাবা-মা ও একমাত্র ছোট বোনটি।

নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার কাঁচপুর ইউনিয়নের সোনাপুর এলাকায় আবু মুসা সরকারের বাড়ির পাঁচ তলায় ছোট্ট একটি রুম ভাড়া নিয়ে স্ত্রী ও দুই ছেলে-মেয়েকে নিয়ে গত চার বছর ধরে বসবাস করছেন শফিকুল ইসলাম। সিদ্ধিরগঞ্জে একটি গার্মেন্টস কারখানায় স্বল্প বেতনে চাকরি করে একার উপার্জনে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন তিনি। তাই পরিবারের হাল ধরতে বাবার সাথে একই কারখানায় চাকরি নেন চব্বিশ বছর বয়সের একমাত্র ছেলে সাব্বির হোসেন মুন্না।

বাবা-ছেলে দুজনের আয়ে তাদের সংসারের খরচ চালানো সহ মুন্নার ছোট বোন সুমাইয়ার লেখাপড়াও চলছিল একটি মহিলা মাদ্রাসায়। এ বছর দাখিল পরীক্ষায় অংশ নেবার কথা থাকলেও মুন্না নিখোঁজ হওয়ার পর বন্ধ হয়ে গেছে সুমাইয়ার লেখাপড়া। ভেঙে পড়েছে পুরো পরিবারটি।

বারের ঈদুল আযহায় সারা দেশে মানুষ ঈদের আনন্দে মেতে উঠলেও গত দুটি ঈদে উৎসবের কোন ছোঁয়া লাগেনি এই পরিবারটিতে। রান্না ঘরে জ্বলেনি চুলো।  নতুন পোশাকও কেনা হয় নি কারো জন্য। শুধু চোখের পানিতে বুক ভাসিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা। মুন্নার বাসায় গিয়ে কথা হয় তার পরিবারের সাথে। দেখা যায় এমন করুণ চিত্র।

নিখোঁজ সাব্বির হোসেন মুন্নার মা মুক্তা বেগম সময় সংবাদকে জানান, গত বছর ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থান শুরু হলে কর্মস্থলে যাওয়ার পাশাপাশি দেশপ্রেমের তাগিদে এলাকাবাসি ও বন্ধুদের সঙ্গে আন্দোলনে অংশ নেন মুন্না। শেষ পর্যায়ে সারা দেশে টানা সরকারি ছুটি ও কারফিউ জারি করা হলে আন্দোলনের মাঠে মুন্না ছিলেন পুরোদমে। ৫ আগস্ট সকালে মাকে ফাঁকি দিয়ে শুধুমাত্র ছোট বোন সুমাইয়াকে জানিয়ে ঢাকার লং মার্চ কর্মসূচিতে কাঁচপুর থেকে মিছিলের সাথে গণভবনের উদ্দেশ্যে রওনা দেন তিনি। এরপর আর বাড়িতে ফিরে আসেননি মুন্না।

ছেলে নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে মা মুক্তা বেগম শোকে পাথর হয়ে গেছেন। কথা বলার শক্তিও যেন হারিয়ে ফেলেছেন। মোবাইল ফোনে মুন্নার ছবি দেখে দিন রাত চোখের পানি ফেলে কান্নায় বুক ভাসাচ্ছেন তিনি।

আন্দোলনে মুন্নার সহযোদ্ধা গার্মেন্টস কর্মী মো. হাসান আলী সময় সংবাদকে বলেন, 'গত ৫ আগস্ট বিকেল ৪টায় যাত্রাবাড়ি হানিফ ফ্লাইওভারের টোল প্লাজার সামনে মুন্নার সাথে আমার শেষ কথা হয়। দেশ স্বাধীনের অংশীদার হতে জীবনের মায়া ত্যাগ করে যাত্রাবাড়ি হানিফ ফ্লাইওয়ারের টোলপ্লাজা এলাকায় এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ উপেক্ষা করেই সামনে অগ্রসর হচ্ছিল মুন্না। এ সময় আমি তাকে বাধা দেই এবং সামনে অগ্রসর হতে নিষেধ করি। তখন মুন্না আমাকে বলে কত মানুষ জীবন দিচ্ছে। আমিও দেশের জন্য শহীদ হয়ে যাব। এই বলে মুন্না প্রচণ্ড গোলাগুলির মধ্যে সামনে এগিয়ে যায়। একপর্যায়ে নিজ এলাকার লোকজন, বন্ধুবান্ধব ও আমাদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিখোঁজ হয় মুন্না। এ ছিল মুন্নার সাথে আমার শেষ কথা ও শেষ দেখা।'

মুন্না নিখোঁজ হওয়ার পর পরিবারের সদস্যরা রাজধানীর প্রায় সবগুলো হাসপাতাল, মর্গ ও থানায় খোঁজ করলেও নিখোঁজ মুন্নার সন্ধান মেলেনি আজও।

এ ঘটনায় মুন্নার পরিবার গত ১৮ আগস্ট সোনারগাঁ থানায় জিডি করেন। এরপর জিডির কপি নিয়ে আড়াইহাজার সেনাবাহিনীর ক্যাম্পেও লিখিতভাবে বিষয়টি জানান। তবে আজ অবধি মুন্নার কোন হদিস পাওয়া যায় নি। এ অবস্থায় মুন্না বেঁচে আছে নাকি আন্দোলনে গয়ে শহীদ হয়েছে এ নিয়ে চরম হতাশা, দিশেহারা ও অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে মুন্নার পরিবার।

নিখোঁজ মুন্নার বাবা শফিকুল ইসলাম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, 'ছেলের ছবি নিয়ে কত জায়গায় খুঁজলাম পাইলাম না। ঢাকার প্রায় সব হাসপাতালে গেছি। থানায় গেছি। সোনারগাঁ থানায় জিডি করলাম। জিডির কপি নিয়া আড়াইহাজার সেনাবাহিনীর ক্যাম্পেও গেছি। কেউ আমার মুন্নার সন্ধান দিতে পারেনি। সবাই শুধু বলে আমরাও খুজি। আপনারাও খোঁজেন। কিন্তু খুঁজেতো ছেলেকে পেলাম না।'
মুন্নার বাবা শফিকুল ইসলাম বলেন, 'ছেলে বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে জানি না। ছেলের লাশটাও যদি পেতাম তাহলে নিজের হাতে দাফন করে মনকে অন্তত সান্ত্বনা দিতে পারতাম। আমার একটা মাত্র ছেলে। আমি মরে গেলে আমাকে মাটি দেওয়ার মতো পরিবারে আর কেউ নাই।' এই বলে অঝোর নয়নে কাঁদতে থাকেন নিখোঁজ সাব্বির হোসেন মুন্নার বাবা শফিকুল ইসলাম।

মুন্নার ছোট বোন সুমাইয়া আক্তার বলেন, 'একটামাত্র ভাই ছিল আমার। ভাইয়ের আদরের একমাত্র ছোট বোন আমি। ভাইকে ছাড়া আমার জীবন শেষ হয়ে গেছে। আমি আমার ভাইকে ফিরে চাই। যদি মরে গিয়ে থাকে তাহলে লাশটা অন্তত দেখতে চাই।'

এদিকে, জেলা প্রশাসনের তৈরি গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের তালিকায় পাওয়া যায়নি মুন্নার নাম। নেই আহতদের তালিকায়ও। তবে কি মুন্না এখনও পড়ে আছে হাসপাতালের কোন হিমাগারে? নাকি ঠাঁই হয়েছে অজ্ঞাত শহীদদের কোন গণকবরে? এমন প্রশ্ন তুলেছেন নিখোঁজ মুন্নার পরিবার সহ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারাও।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নারায়ণগঞ্জ জেলা সদস্য সচিব মো. জাবেদ আলম সময় সংবাদকে বলেন, 'আন্দোলনে অংশ নেয়া স্থানীয় ছাত্রদের কাছ থেকে আমরা মুন্নার নিখোঁজের বিষয়টি জানতে পারি। পরে তার বাসায় গিয়ে পরিবারের সঙ্গে কথা বলি। আমরাও আমাদের অবস্থান থেকে বিভিন্ন ভাবে খোঁজ করেছি। জেলার শহীদ ও আহতদের তালিকাও দেখেছি। কোথাও মুন্নার নাম পাইনি। আমরা আশা করব সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো বিষয়টি গুরুত্ব দেবে এবং মুন্নার সন্ধানে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে।'

এ বিষয়ে তদন্ত সহ সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরকে অবগত করার আশ্বাস দিয়েছেন নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক জাহিদুল ইসলাম মিঞা।

বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে জেলা প্রশাসক জাহিদুল ইসলাম মিঞা সময় সংবাদকে বলেন, 'জেলায় যারা শহীদ হয়েছেন তাদের তালিকা আমাদের কাছে আছে। যারা আহত হয়েছেন তাদের তালিকাও আমাদের কাছে এসেছে। গত ৫ আগস্ট থেকে সাব্বির হোসেন মুন্না নামে কেউ নিখোঁজ আছে এ বিষয়টি আমাদের নলেজে নাই। যদি কেউ মিসিং হয়ে থাকে আমরা অবশ্যই তার জন্য ব্যবস্থা নেবো। আমরা সংশ্লিষ্ট দপ্তর ও প্রশাসনের সাথে কথা বলবো। সে কীভাবে মিসিং হলো, কোথায় আছে সেটা আমরা অবশ্যই তদন্ত করার ব্যবস্থা নেব।'