শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪

|

বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

Advertisement
Narayanganj Post :: নারায়ণগঞ্জ পোস্ট

‘ভালা সময় কবে আইব, জানেন কিছু?’

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

প্রকাশিত: ২০:৪৬, ১৮ আগস্ট ২০২২

‘ভালা সময় কবে আইব, জানেন কিছু?’

প্রতীকী ছবি

‘অ ভাই, প্যাকেটটা দেন না। শনিবারেই টেকা দিয়া দিমু। দেন না।’ সুলতানার এমন মিনতিতেও মন গলে না মুদিদোকানির। দোকানভরা মানুষের সামনেই ধমকের স্বরে বলে ওঠেন, ‘হইব না, যাইতে বলছি, যাও। ব্যবসার অবস্থা ভালা না।’

মুখে যন্ত্রণা আর অপমানের ছাপ নিয়ে দোকান থেকে বের হয়ে আসেন চল্লিশোর্ধ্ব সুলতানা বেগম। পরনে ময়লা ছাপা শাড়ি। হাতে কালো পলিথিনের পুঁটলি। দোকানের বাইরে এসে সড়কের ফুটপাত ঘেঁষে দাঁড়ান। হাতে থাকা পুঁটলির ভেতর হাতড়ে দুই টাকার তিনটি নোট ছাড়া আর কিছুই পেলেন না তিনি।

কাছে গিয়ে ডাকলে চমকে ওঠেন। দোকানির খারাপ আচরণের কারণ জানতে চাই। ‘না, না। নাতিডার লাইগা দুধ নিতে গেছলাম। দোকানদার বাকি দেয় নাই। ওনার ব্যবসার অবস্থাও ভালা না।’ মুখে জোর করে হাসির রেখা টেনে প্রশ্নের উত্তর দেন। ব্যস্ত সড়কে দাঁড়িয়েই কথা হয় তাঁর সঙ্গে।

গতকাল বুধবার রাত ১০টা। নারায়ণগঞ্জের বন্দরঘাট এলাকায় তখন হাজারো মানুষের ভিড়। অধিকাংশই পোশাক কারখানার শ্রমিক। সকালে যাঁরা শীতলক্ষ্যা পাড়ি দিয়ে শহরে কাজে গিয়েছিলেন, দিন শেষে তাঁরা এখন বাড়ি ফিরছেন। সুলতানা সেই শ্রমিকদের একজন। নারায়ণগঞ্জের ডিআইটিতে একটি হোশিয়ারি কারখানায় কাজ করেন সপ্তাহে ১ হাজার ৭০০ টাকা বেতনে। অবসর সময়ে ফেলনা কাপড় কুড়িয়ে শিশুদের প্যান্ট সেলাই করেন। এখানে–সেখানে ঘুরে সেসব প্যান্ট বিক্রি করেন। প্রতি জোড়া ৩০ টাকা দরে।

বন্দরঘাটের পাশেই আমিন আবাসিক এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকেন সুলতানা। সঙ্গে থাকেন ছেলে, ছেলের বউ আর ৯ মাস বয়সী নাতি। নাতির জন্যই বাকিতে দুধ কিনতে গিয়েছিলেন। সপ্তাহের শেষ। শূন্য হাত। দোকানি অপমান করে ফিরিয়ে দিয়েছেন। তবে সুলতানার কাছে দোকানির অপমানের চেয়ে দুধ কিনতে না পারার যন্ত্রণাটা বড়। সে কথাই জানান।

‘কারখানার অবস্থা ভালা না। মহাজন জানাইছে, এই সপ্তায় বেতন দিতে পারব না। বেতন দেবে শনিবার। এর মধ্যে নাতিডার দুধ কিনার টেকা নাই। মহাজনরে কইলাম ১০০ টেকা দিতে। দিল না। এ কারণে মনডায় অনেক কষ্ট লাগতাছে। নাতিডা বুকের দুধ পায় না। দুইডা কথা শোনাইয়াও যদি দুধটা দিয়া দিত।’

সুলতানার স্বামী ছিলেন হোশিয়ারি কারখানার কাটিং মাস্টার। বিয়ের পাঁচ বছরের মাথায় স্বামী হারিয়েছেন। সুলতানার কোলে তখন তিন বছরের ছেলে মো. রবিন। সেই ছেলেকে কোলে করেই হোশিয়ারিতে শ্রমিকের কাজ শুরু। তারপর কেটে গেছে ১৭ বছর। একাই কোলেপিঠে করে ছেলেকে বড় করেছেন। বিয়ে করিয়েছেন। ছেলের ঘরে সন্তান জন্ম নিয়েছে। অভাবের সংসারে ছেলেসন্তানের জন্ম সুলতানার কাছে সৌভাগ্যের প্রতীক। তাই আশা করে নাতির নাম রেখেছেন রহমত আলী।

সুলতানার ছেলেও এখন হোশিয়ারি কারখানায় কাজ করেন। মাসিক বেতন ১০ হাজার টাকা। মা–ছেলের হিসাবি ব্যয়ে কোনো রকম সংসার চলছিল তাঁদের। কিন্তু সেই হিসাবে গোলমাল পাকিয়েছে নিত্যপণ্যের বাড়তি বাজারদর। সঙ্গে বেড়েছে শিশুখাদ্যের দামও। সুলতানার কপালে তাই চিন্তার ভাঁজ। রহমত আলীর জন্মের সময় অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে। তখন থেকেই ছেলের বউ অসুস্থ। সেই অসুস্থতা সংকট আরও বাড়িয়েছে।

‘নাতিডা দুধ পায় না। ডাক্তারের কাছে নিছিলাম। ওনি কইলেন বউরে ভালামন্দ খাওয়াইতে। সিজারের রোগী। ভাত আর অষুদ খাইতেই টেকা শেষ। ভালামন্দ খাওয়াই কেমনে? আগে এক প্যাকেট গরুর দুধ নিত ষাইট টেকা। এহন নেয় আশি টেকা। এক হালি ডিমের দাম ৫৮ টেকা। বাজারে গেলেই মাথাডা চক্কর দেয়।’

এত কিছুর মধ্যেও একটা আশা সুলতানাকে স্বপ্ন দেখাচ্ছে। ছেলের শ্বশুরবাড়ির এক আত্মীয় মালদ্বীপপ্রবাসী। বাংলাদেশে খেয়েপরে বাঁচতে কষ্ট হচ্ছে জানিয়ে তাঁকে মালদ্বীপ নিয়ে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন ছেলে। সেই আত্মীয় রাজি হয়েছেন। কিন্তু বিদেশ যাওয়ার খরচ জোগাড় হচ্ছে না। মহাজনের কাছে তাই অগ্রিম টাকা চেয়েছেন সুলতানা। মহাজন জানিয়েছেন, এখন ভালো সময় নয়। ভালো সময় এলে টাকা দেবেন। সে কথা মনে করতেই সুলতানার প্রশ্ন, দেশের পরিস্থিতি কী, ভালা সময় কবে আইব, জানেন কিছু?’

কথায় কথায় রাত বাড়ে। সুলতানার প্রশ্নের আর উত্তর দেওয়া হয় না। রাত পোহালেই আবার কাজে ফিরতে হবে তাঁকে। ঘরে ফিরতে চান। চলে যাওয়ার সময় সুলতানার একটি ছবি তোলার অনুমতি চাই। অনেকটা আতঙ্কের স্বরেই সুলতানা বাধা দেন, ‘না না, ছবি তুইলেন না। ভালামন্দ কত কথা কইছি। কোন না কোন বিপদে পড়ি।’ এ কথা বলেই পা বাড়ান সুলতানা।