শনিবার, ০৪ মে ২০২৪

|

বৈশাখ ১৯ ১৪৩১

Advertisement
Narayanganj Post :: নারায়ণগঞ্জ পোস্ট

আমাকে ষড়যন্ত্র করে ফাঁসানো হয়েছে: ক্যাসিনো ডন সেলিম

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

প্রকাশিত: ২১:১৩, ২০ এপ্রিল ২০২৪

আমাকে ষড়যন্ত্র করে ফাঁসানো হয়েছে: ক্যাসিনো ডন সেলিম

ফাইল ছবি

আলোচিত ক্যাসিনোকাণ্ডের অন্যতম হোতা সেলিম প্রধান নিজের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে চার বছর পর সংবাদ স‌ম্মেল‌নে জানি‌য়ে‌ছেন, তি‌নি ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন এবং তাকে পরিকল্পিতভাবে ফাঁসিয়ে দেয়া হয়েছে। 

শনিবার (২০ এপ্রিল) দুপুরে নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাব ভবনের দ্বিতীয় তলায় একটি রেস্টুরেন্টে সংবাদ সম্মেলনে তিনি এই অভিযোগ করেন। এসময় তার স্ত্রী, সন্তান ও তার আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন।

সংবাদ সম্মেলনে তিনি অভিযোগ করেন ২০১৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর আমাকে ষড়যন্ত্র করে ফাঁসানো হয়েছে। একটি বাহিনীর সাবেক প্রধান কর্মকর্তার দুই ভাই (হারিছ আহমেদ ও জোসেফ আহমেদ) পরিকল্পিতভাবে আমাকে ফাঁসিয়ে দিয়েছে। আন্তর্জাতিক মিডিয়া আল জাজিরায় তাদের নিয়ে ভিডিও প্রকাশিত হয়েছে।

সেখানে হারিছ স্পষ্ট করে বলেছে, আমাকে কীভাবে ফাঁসানো হয়েছে, কীভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার করে র‌্যাব দিয়ে আমাকে প্লেন থেকে আটক করা হয়েছে। অথচ এয়ারপোর্টে ইমিগ্রেশন অতিক্রম করার মানে হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই। আইনি কোনো মামলা বা জটিলতা নেই। তারপরও আমাকে প্লেন থেকে গ্রেফতার করে পরিকল্পিতভাবে নাটক সাজিয়ে গ্রেফতার করেছে।

সেলিম বলেন, আমার বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগ তোলা হয়। এরপর ক্ষমতার অপব্যবহার করে আমাকে চার বছর একদিন জেল খাঁটিয়েছে। আমি ওই ষড়যন্ত্রকারীদের বিচার চাই। আমি জেল থেকে বের হয়ে এই ষড়যন্ত্রের কথা গণমাধ্যমে বলে এসেছি। এমনকি জেলে আটক থাকা অবস্থায়ও বলেছি। তারপরও আমার নিরপরাধ হওয়ার নানা তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে দীর্ঘ সময় লেগেছে। এগুলো সম্পন্ন করে আপনাদের সামনে উপস্থিত হয়েছি।

তিনি আরও বলেন, রাজনীতি করার ইচ্ছা আমার নেই। এটা এক ধরনের জব। আমি চাই মানুষ যা চায়, তা যেন পায়। জনগণ মনে করেন আমি ভোটটা দিলাম আপনারা আমাদেরকে দেখবেন। অথচ ভোট পাওয়ার পরে গরীব নিরীহ মানুষের খবর আর কেউ নেয় না। ওই সময় জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে রূপগঞ্জে সেলিম প্রধানের আকস্মিক বিচরণ, তখন নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল জনমনে। তবে শেষ পর্যন্ত জাতীয় নির্বাচনের সময় তাকে আর দেখা যায়নি।

ক্যাসিনো সম্রাট সেলিম প্রধানের পৈতৃক বাড়ি রূপগঞ্জ উপজেলার ভুলতা মর্তুজাবাদ এলাকায়। এলাকায় তাঁদের বাড়িটি ‘মিয়া বাড়ি’ হিসেবে পরিচিত।। সেলিম প্রধানের বাবা নান্নু মিয়া ভুলতায় এক সময় কাপড়ের ব্যবসা করতেন।

স্থানীয়দের তথ্যমতে, সেলিম প্রধানের বাবা এক সময় ঢাকায় এসে ব্যবসা শুরু করেন। এরপর থেকে এলাকার সঙ্গে তাদের পরিবারের যোগাযোগ খানিকটা কমে যায়। নান্নু মিয়ার তিন ছেলে ও তিন মেয়ের জনক। ছেলেদের মধ্যে সেলিম তার দ্বিতীয় সন্তান। নান্নু মিয়া ১৯৮৮ সালে তার বড় ছেলে আলম মিয়াকে জাপান পাঠান। বড় ভাইয়ের মাধ্যমে সেলিম প্রধানও পরে জাপানে চলে যান। সেখানে তিনি পড়াশোনা ও কাজ করতেন। জাপানি এক নারীকে তিনি বিয়ে করেন।

মর্তুজাবাদে সেলিম মিয়ার প্রতিবেশীদের তথ্যমতে, জাপানে থাকার সময় সেলিম প্রধান তার ফুপাতো ভাইয়ের সঙ্গে গাড়ির ব্যবসা শুরু করেন। পরে তার ব্যবসার প্রসার আরও বাড়তে থাকে।

একাধিক সূত্রে জানা গেছে, রূপগঞ্জ উপজেলার সাওঘাট এলাকায় সেলিম প্রধানের জাপান বাংলাদেশ (জেবি) সিকিউরিটি প্রিন্টিং অ্যান্ড পেপারস নামে একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সেলিম প্রধান ওই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান। এ ছাড়া তিনি পি-২৪ নামে ল ফার্মেরও মালিক। পি-২৪ নামে অনলাইন ক্যাসিনোর জন্য একটি অ্যাপস রয়েছে।

গ্রেপ্তার ও কারাভোগের কাহিনি
সেলিম প্রধান চার বছর আগে গ্রেপ্তার হন র‌্যাবের হাতে। এরপর একে একে চারটি মামলা হয় তার বিরুদ্ধে। এর মধ্যে দুদকের মামলায় তাকে দুই ধারায় চার বছর করে মোট আট বছরের সাজা দেন আদালত। তবে উভয় সাজা একসঙ্গে চলবে বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়। ওই মামলায় চার বছর সাজা খাটা শেষ। বাকি তিন মামলায় জামিনে থাকায় এরই মধ্যে মুক্তি পান তিনি।

সূত্রমতে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান চলাকালে ২০১৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর থাই এয়ারওয়েজের ফ্লাইটে ব্যাংকক যাওয়ার সময় হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সেলিম প্রধানকে আটক করে র‌্যাব-১। এরপর তার গুলশান, বনানীর বাসা ও অফিসে অভিযান চালিয়ে ২৯ লাখ টাকা, বিপুল বিদেশি মদ ও বিভিন্ন দেশের মুদ্রা জব্দ করা হয়। একইসঙ্গে উদ্ধার করা হয় হরিণের চামড়া। ওই দিনই বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনে ছয় মাসের কারাদণ্ড দিয়ে সেলিম প্রধানকে কারাগারে পাঠায় ভ্রাম্যমাণ আদালত।

তার বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলাটি ঢাকার চতুর্থ যুগ্ম মহানগর দায়রা জজ আমিরুল ইসলামের আদালতে বিচারাধীন। ২০২২ সালের ২৪ আগস্ট ১০ হাজার টাকা মুচলেকায় আদালত তার জামিন মঞ্জুর করেন। বৈদেশিক মুদ্রা আইনের আরেক মামলা সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে। ২০২২ সালের ৯ জানুয়ারি ঢাকার তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত সে মামলায় তার জামিন মঞ্জুর করেন।

এছাড়া মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে র‌্যাব বাদী হয়ে গুলশান থানায় মামলা করেন। তদন্ত শেষে ২০২০ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিটের পরিদর্শক মো. শহিদুল ইসলাম খান ৬ আসামির বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট জমা দেন। ২০২২ সালের ৩০ আগস্ট ঢাকার বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালত মামলাটি অধিকতর তদন্তে পাঠানোর আদেশ দেন। বর্তমানে সেটি সিআইডির তদন্তাধীন। এ মামলায়ও তিনি জামিনে রয়েছেন।

অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ২০১৯ সালের ২৭ অক্টোবর সেলিমের বিরুদ্ধে মামলা করেন দুদকের উপপরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধান। প্রাথমিকভাবে তার বিরুদ্ধে ১২ কোটি ২৭ লাখ ৯৫ হাজার ৭৫৪ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়। তদন্ত করে শেষ পর্যন্ত ৫৭ কোটিরও বেশি টাকার অবৈধ সম্পদের প্রমাণ পাওয়া যায়।

২০২১ সালের ৩১ অক্টোবর আসামির উপস্থিতিতে অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে বিচার শুরুর আদেশ দেন আদালত। গত ৩০ এপ্রিল ঢাকার বিশেষ আদালত-৮-এর বিচারক বদিউল আলম মানিলন্ডারিং আইনে ৪ বছরের কারাদ- ও ১০ লাখ টাকা জরিমানা এবং অনাদায়ে আরও ৬ মাসের কারাদণ্ড দেন। এ ছাড়া জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের দায়ে দুদক আইনে ৪ বছরের কারাদণ্ড ও ১ লাখ টাকা এবং অনাদায়ে আরেক মাসের কারাদণ্ড দেয়া হয়।

প্রসঙ্গত: ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর ক্যাসিনো সম্রাট সেলিম প্রধানের দখলে থাকা রূপগঞ্জের ভুলতা-গোলাকান্দাইল চার তলা বিশিষ্ট ফ্লাইওভারের ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের অংশের সওজের জমি উদ্ধার করেছে প্রশাসন। ওই দিন সকাল ১০টা থেকে দিনব্যাপী যুগ্মসচিব এবং সড়ক ও জনপদ (সওজ) অধিদপ্তরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মাহবুবুর রহমান ফারুকীর নেতৃত্বে জাপান বাংলাদেশ সিকিউরিটি প্রিন্টিং লিমিটেডের অবৈধ দখলে থাকা ১৫ শতাংশ জমির পাকা স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়। জেলা প্রশাসক জসিম উদ্দিন ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার মমতাজ বেগমের সহায়তায় আরও বেশ কয়েকটি দোকান ঘরসহ পাকা স্থাপনা ভেঙে দখলমুক্ত করা হয়।