শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪

|

বৈশাখ ১৯ ১৪৩১

Advertisement
Narayanganj Post :: নারায়ণগঞ্জ পোস্ট

ধ্বংসের মুখে জামদানি পল্লী

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

প্রকাশিত: ১৩:৫৪, ২৪ মার্চ ২০২৪

আপডেট: ১৫:২৭, ২৪ মার্চ ২০২৪

ধ্বংসের মুখে জামদানি পল্লী

ফাইল ছবি

লাল রঙের শাড়িতে/ দালিম-ফুলের মত রাঙা/ আজ পরেছে কালো রেশমের কাপড়/ আঁচল তুলেছে মাথায়/ দোলন-চাঁপার মত চিকন-গৌর মুখখানি ঘিরে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার হঠাৎ দেখা কবিতায় রেশমের শাড়ি পরা মেয়েটির বর্ণনা এভাবে দিয়েছেন। সত্যিতো ঢাকাই জামদানিতো তাঁতে লেখা যেন কবিতা। বাঙালির গৌরবের যে মসলিন সারা বিশ্বের বিস্ময়, জামদানি তার উত্তরাধিকার। জামদানি শাড়ি ভালোবাসেন না, এমন বাঙালি নারী খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। নারীকুলের জামদানির প্রতি ভালোবাসা চিরন্তন। তবে বাঙালি নারী শুধু নয়, সারা বিশ্বেই জামদানি শাড়ির সুনাম ছড়িয়ে আছে। অথচ অনিয়ম আর দুর্নীতির কারণে জামদানি পল্লী প্রকৃত তাঁতীদের হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। এতে হুমকির মুখে পড়ছে জামদানি শিল্প।

বিশ্বখ্যাত জামদানি তৈরি হয় রাজধানী ঢাকার পাশেই অবস্থিত নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জে। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার নোয়াপাড়া গ্রামকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে জামদানি পল্লী। জামদানি শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকার কোটি কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছে। রূপগঞ্জ অঞ্চলের জমির দাম কাঠা প্রতি অনেক বেশি হলেও সরকার ভর্তুকি দিয়ে জমির দাম অনেক কম মূল্য প্রদান করে। কিন্তু প্রকৃত তাঁতীরা তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। স্থানীয় প্রভাবশালী নেতাকর্মী, জনপ্রতিনিধি ও দালালের দৌরাত্ম্যের কারণে তাঁতীদের জন্য বরাদ্দকৃত সরকারি প্লটগুলো ক্রমেই চলে যাচ্ছে যাদের তাঁত শিল্পে সঙ্গে কোন সম্পৃক্ততা নেই তাদের হাতে। নোয়াপাড়া বিসিক শিল্প নগরীতে নিরীহ তাঁতীদের প্লট নিয়ে অনিয়ম ও দুর্নীতির হিড়িক চলছে। এতে তাঁতিরা যেমন বঞ্চিত হচ্ছে তেমনি এ ঐতিহ্যবাহী জামদানি শিল্প ক্রমেই ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছে।

নোয়াপাড়া বিসিক শিল্প নগরী অফিস ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, জামদানি পল্লীকে বাঁচিয়ে রাখতে ১৯৯৯ সালে রূপগঞ্জ উপজেলা নোয়াপাড়া এলাকায় মোট ২০ একর জমিতে ৪১৬টি প্লট করে তাঁতীদের পুনর্বাসন করে সরকার। ২০০১ সালে এককালীন ১ লাখ ৭২ হাজার টাকা ও কিস্তিতে সর্বনিম্ন ৪০ হাজার টাকা ডাউন পেমেন্ট দিয়ে বাকী টাকা ১০ কিস্তিতে পরিশোধ করার শর্তে বরাদ্দ দেওয়া হয়। প্রকৃত তাঁতীদের কাছে ৪০৭ টি প্লট হস্তান্তর করে ৫ বছরের মাঝে ১০ কিস্তিতে প্লটগুলোর কিস্তি পরিশোধ করতে বলা হয়। বাকী ৯টি প্লট পল্লী বিদ্যুৎ ও পাম্প হাউজের জন্য সংরক্ষিত করে রাখা হয়। প্লট বরাদ্দের পর থেকে প্রকৃত তাঁতীদের সরলতার সুযোগ নিয়ে ও তাদের জিম্মি করে স্থানীয় নেতাকর্মী, জনপ্রতিনিধি ও দালালরা প্রভাব দেখিয়ে স্বল্প টাকায় অবৈধভাবে প্লট ক্রয় করে নিচ্ছে। এতে করে যাদের সঙ্গে জামদানি শিল্প বা তাঁতের সঙ্গে কোন সম্পৃক্ততা নেই তারা এখন প্লট ভোগ করছে। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী যদি কোন সরকারের দেয়া প্লটগুলো বিক্রি অথবা হস্তান্তর করতে চায় তাহলে তাকে অবশ্যই বিসিক শিল্প নগরী অফিসকে জানাতে হবে। প্লট বিক্রির সময় বিসিক কর্তৃপক্ষ দেখবে তিনি যার কাছে প্লট বিক্রি করছেন সে প্রকৃত তাঁতী কিনা। প্রকৃত তাঁতী ছাড়া বিসিকে কেউ প্লট ক্রয় করতে পারবে না বলে জানান বিসিক কর্তৃপক্ষ। তবে সরকারি নিয়মকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, প্রভাবশালী নেতাকর্মী ও দালালদের সমন্বয়ে কখনো হুমকি ধামকি অথবা সরলতার সুযোগে প্রকৃত তাঁতীদের কাছ থেকে অবৈধভাবে প্লট ক্রয় চলছে দেদারছে। বিসিকে প্রকৃত তাঁতীদের জন্য বরাদ্দকৃত ৪০৭ টি প্লটের মাঝে ২২১ টি প্লটই বিসিক কর্তৃপক্ষকে না জানিয়ে অবৈধভাবে ক্রয় করা হয়েছে। যার সিংহভাগ প্লটেই তাঁতের কোন কার্যক্রম চলে না। আবার কেউ প্লট কিনে ঘর বানিয়ে ভাড়া দিয় রেখেছে। মোট ২২৬ টি প্লটে ভাড়া দিয়ে রাখা হয়েছে যেগুলোতে কোন প্রকার জামদানি বুনন কার্যক্রম চলে না। যাও কয়েকটিতে চলে তাও লোক দেখানো। এসকল সমস্যার কারণে প্রকৃত তাঁতীরা জামদানি শিল্প থেকে দূরে চলে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে রূপগঞ্জ উপজেলার ঐতিহ্যবাহী জামদানি পল্লী ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাবে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, অবৈধভাবে প্লট ক্রয়-বিক্রয় এখনো থেমে নেই। প্রভাবশালীদের তোপের মুখে প্রকৃত তাঁতীরা মূল্যায়ন পাচ্ছে না। শাহনাজ জামদানির মালিক হিরুন্নেসা তাঁতী হিসেবে এ-৩৯ নং একটি প্লট পান। তিনি প্লটের কয়েকটি কিস্তি পরিশোধ করলেও সম্পূর্ণ কিস্তি পরিশোধ করতে পারেনি। কয়েক বছর আগে প্লটটি তিনি স্বল্প টাকায় বিসিক কর্তৃপক্ষকে না জানিয়ে অবৈধভাবে কবির হাসেন নামের স্থানীয় এক ব্যক্তির কাছে বিক্রি করে দেন। কবির হোসেনও প্লটটি ক্রয়ের পর কিস্তি পরিশোধ করেনি। তার প্লটে জামদানির কোন অস্তিত্ব নেই তিনি প্লটে ৫টি ঘর করে ভাড়া দিয়ে রেখেছেন। নুরুল হক জামদানির মালিক নুরুল হক তার পাওয়া এ-৬৩ নং প্লটটিও অবৈধভাবে বিসিক কর্তৃপক্ষকে না জানিয়ে আলী আলম নামের একজনের কাছে বিক্রি করেন। প্লটটি ক্রয়ের পর তিনি এখানে বসবাস করলেও জামদানি বুননের কোন কাজ করছে না। তাঁতী মোহাম্মদ আলী এ-১০১ নং প্লটটি তিনি সালেহা বেগমের কাছে বিক্রি করলেও তিনিও জামদানি বুননের কোন কাজ করেন না। এছাড়া এ পর্যন্ত কোন কিস্তিও পরিশোধ করেনি। আরেক তাঁতী খায়রুদ্দিন বাড়িতে একটি মাত্র কক্ষে জামদানির তাঁত রয়েছে। তার বাকী কক্ষগুলোতে ৪টি ভাড়াটিয়া রেখেছেন। বিসিক কর্মকর্তা ও স্থানীয় প্রভাবশালীদের ম্যানেজ করে রাজীয়া সুলতানা এ-১৬৩ নং নামে প্লট পান। অথচ তার বাড়িতে জামদানি বুননের কোন কার্যক্রম নেই। তিনি বাড়িতে ৫ জন ভাড়াটিয়া রেখেছেন। নিলুফা বেগমও নিজেকে তাঁতী দেখিয়ে এ-২০৬ নামে একটি প্লট বাগিয়ে নেন। তার ঘরেও কোন তাঁতকল অথবা কারখানা নেই। সুমাইয়া জামদানির মালিক মনির হোসেন কোন প্রকার তাঁত চালায় না। তার এখনো প্লটের কিস্তি বকেয়া রয়েছে। তারাবো পৌরসভার মহিলা সংরক্ষিত আসনের ইউপি সদস্য জোসনা আক্তার তাঁতী না হয়েও উপর মহলকে ম্যানেজ করে তার স্বামী আনোয়ার হোসেনের নামে একটি প্লট বাগিয়ে নেন। তার বাড়িতে দেখানোর জন্য একটি তাঁত থাকলেও এটি মাসে একবারও চালানো হয় না। জোসনা বেগমের এখনো প্লটের ৪টি কিস্তি বকেয়া রয়েছে। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী একজন তাঁতী জামদানি বিক্রির জন্য এটি শোরুম দিতে পারলেও অনেকে তাঁতী না হয়েও প্রভাব খাটিয়ে একের অধিক শোরুম দিয়ে রেখেছে। আকাশ জামদানির মালিক আকাশ মিয়া প্লট নং এস-১৭ তিনি অন্য মানুষের কাছে দুটি শোরুম ভাড়া দিয়ে রেখেছেন। আলী আলম নিজের তাঁতের সঙ্গে সম্পৃক্ত না থাকলেও স্থানীয় দলীয় প্রভাব দেখিয়ে ৩ টি শোরুম ভাড়া দিয়ে রেখেছেন। এসময় অনিয়মের বিষয়ে জামদানি কর্মকর্তারা প্রতিবাদ করলে তাদের দলীয়ভাবে হুমকি ধামকি ও বিসিক অফিস ঘেরাওয়ের হুমকি দেওয়া হয়। এছাড়া কোন প্লট মালিকই সার্ভিস চার্জ নিয়মিত দেন না বলে জানান বিসিক কর্তৃপক্ষ। এভাবে চলতে থাকলে জামদানি পল্লী কালের আবর্তে হারিয়ে যাবে। জামদানি পল্লীর প্লটগুলো পুনরায় প্রকৃত তাঁতীদের কাছে হস্তান্তরের দাবি জানান স্থানীয়রা। প্লটগুলো প্রকৃত তাঁতীদের কাছে হস্তান্তর করলে জামদানি শিল্প টিকে থাকবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।