
ফাইল ছবি
ইয়াসিন এখন দেড় বছর বয়সী। কেবল কথা বলতে শেখা শুরু করেছে। মায়ের সাথে বাবার কবরের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে ‘বাবা’— বোলে আধো আধো করে ডাকে। কিন্তু সে জানে না, যে মানুষটিকে ‘বাবা’ বলে ডাকার জন্য তার এত আগ্রহ—সে তো নেই। বাবা বলার আগেই, অবুঝ শিশুটি তার বাবাকে হারিয়ে ফেলেছে।
২০২৪ সালের ১৯ জুলাই বিকেলে নারায়ণগঞ্জের জালকুড়ি বাসস্ট্যান্ডে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন জামাল ভূইয়া (২৭)। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের উত্তাল দিনে গুলির মুখে পড়ে প্রাণ হারান নিরীহ এই যুবক। তার মৃত্যুর পর পরিবারটি যেন একেবারে দিকহারা হয়ে পড়েছে।
জামালের গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালীর রাঙাবালি উপজেলার বড়বাইশদিয়া ইউনিয়নে। আড়াই বছর আগে একই এলাকার মানসুরা আক্তারকে বিয়ে করেছিলেন জামাল। বিয়ের এক বছরের মাথায় জন্ম নেয় তাঁদের সন্তান ইয়াসিন। সেই ইয়াসিনকেই ঘিরে ছিল তাঁদের স্বপ্ন—ছেলেকে বড় হাফেজ বানানোর পরিকল্পনা করছিলেন জামাল।
শহীদের স্ত্রী মানসুরা আক্তার এখন ছেলেকে নিয়ে নারায়ণগঞ্জের বাসায় থাকেন। চোখে ক্লান্তি, কণ্ঠে কান্না—জীবনের ভার যেন তাঁকে চেপে ধরেছে। তিনি বললেন, ‘আমার স্বামী অনেক ভালো মানুষ আছিল। দেড় বছরের সংসারে কোনো দিন একটা কঠিন কথা কয় নাই। মৃত্যুর এক ঘণ্টা আগেও হাসিখুশি মুখে আমারে ভিডিও কলে ছেলে দেখায়, কয়—মানসুরা, ওয় কবে বাবা ডাকবে?’
থেমে থেমে কান্নার মধ্যেও বলেন, ছেলে এখন ‘বাবা’ ডাকে। মাঝে মাঝে কাকারে দেখে ‘বাবা’ বলে। তখন বুকটা ফেটে যায়... ও তো ওর বাবারে চিনেই না। জামাল তো এই ডাকটাই শুনতে পারল না।
জালকুড়ি বাসস্ট্যান্ডে জামালের একটি ছোট মুরগির দোকান ছিল। সেখানেই ঘটনার দিন দুপুরে খাবার খেয়ে যান। বড় ভাই আলমাস ভূঁইয়া বারবার নিষেধ করলেও দোকানে যান জামাল। ভাইয়ের কথায়, ‘ও কয়, কিছু হইবো না ভাই, আমি একটু যাইয়া আবার চইলা আইতাছি। দোকানে না বসলে সংসার চলবো কেমনে? আমাদের ভাই-ব্রাদাররা আন্দোলনে, আমি যাই না, তাই তো হেইলাম।’
কিন্তু ফিরে আসা হয়নি জামালের। দোকানের ভেতরেই এসে পড়ে এক পুলিশি গুলি। পায়ের ওপর দিয়ে ঢুকে আরেক পা ছেদ করে বের হয়ে যায়। এরপর যা ঘটে, তা যেন আলমাসের দুঃস্বপ্ন: চিন্তা করছিলাম বাঁচাইতে পারুম। বাজারের হাসপাতালে নেই, ওরা কয় ঢাকা মেডিকেলে নেন। রাস্তায় গাড়ি চলে না। কত কষ্ট কইরা ওরে ঢাকায় নেই। পথে ও কয়, ভাই, আমি মনে হয় বাঁচতাম না। আমার ইয়াসিনরে দেইখা রাইখো। এই কইয়া কালিমা পড়ে চোখ বন্ধ কইরা ফালায় দিলো...
শহীদের দাফন হয় পরদিন, পটুয়াখালীর বড়বাইশদিয়ায়। শত শত মানুষ শেষবারের মতো দেখতে আসে এই তরুণকে, যে বলেছিল—ছেলেকে হাফেজ বানাবে, আর একদিন বাবা-মাকে গাড়িতে করে হজে নিয়ে যাবে।
জামালের মা মেহেরজান বিবি ছয় সন্তানের মধ্যে ছোট ছেলেকে হারিয়ে দিশেহারা। চোখের পানি শুকায় না তাঁর। কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ছেলেটা দোকানে গেল মুরগিরে আধার দিতে। দোকান না চালাইলে ঘরে খাইবো কী? আর ওখানেই ওরে গুলি করলো! আমার কলিজার টুকরা ডারে পাখির মতো মাইরা ফেললো।
তিনি আরও বলেন, ‘আমার ছেলে তো কোনো রাজনৈতিক নেতা না, কোনো দলেরও না। তাও গুলিতে মরে গেলো। যারা ওরে মাইরা ফেলছে, আল্লাহ তাদের বিচার করুক। ছয় মাসের দুধের বাচ্চারে যারা এতিম করলো, আমি বিচার চাই।’
শহীদ জামালের বড় ভাই আলমাস জানান, ভাইয়ের মৃত্যুর পর তারা ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন’ থেকে ৫ লাখ এবং জেলা পরিষদ থেকে ২ লাখ টাকা সহায়তা পেয়েছেন। সেই টাকা এখন ইয়াসিন ও মায়ের নামে ব্যাংকে গচ্ছিত রাখা হয়েছে।
তবুও যা ফিরে পাওয়া যায় না, তা হলো একজন বাবার স্পর্শ, একজন স্বামীর ছায়া, একজন ছেলের অস্তিত্ব। দেড় বছরের ইয়াসিন জানে না সে আজ একটি জাতির বিবেকের প্রতিনিধি। যার মুখে ‘বাবা’ ডাক উঠেছে, কিন্তু যাকে সে আর কোনো দিন দেখতে পাবে না।
প্রসঙ্গত, ২০২৪ সালের জুলাইয়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা ন্যায্য অধিকার আদায়ের দাবিতে আন্দোলনে নামেন। শুরুতে এই আন্দোলন ছিল শান্তিপূর্ণ, কিন্তু সরকার তা দমন-পীড়নের মাধ্যমে প্রতিহত করার চেষ্টা করে। এতে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। সরকার এই শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে দমন-পীড়নের মাধ্যমে আন্দোলন দমন করতে গিয়ে সরকারই আরও প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়ে। ছাত্র-জনতার শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ দমনে সরকারের সহিংস হস্তক্ষেপে প্রায় হাজারো নিরস্ত্র মানুষ প্রাণ হারান, আহত হন হাজার হাজার। মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে আন্দোলন পরিণত হয় গণঅভ্যুত্থানে। পতন ঘটে টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থেকে দীর্ঘদিন নিপিড়ীন নির্যাতন চালানো আওয়ামী লীগ সরকারের। ক্ষমতাসীন দলের সভানেত্রী শেখ হাছিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন।