শুক্রবার, ১৮ জুলাই ২০২৫

|

শ্রাবণ ১ ১৪৩২

Advertisement
Narayanganj Post :: নারায়ণগঞ্জ পোস্ট

শামীম ওসমান রাজত্বের বুকের উপর দাঁড়িয়ে ছেলেমেয়ে স্লোগান দিচ্ছে : মুনা

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

প্রকাশিত: ১৭:০১, ১৭ জুলাই ২০২৫

আপডেট: ১৭:০২, ১৭ জুলাই ২০২৫

শামীম ওসমান রাজত্বের বুকের উপর দাঁড়িয়ে ছেলেমেয়ে স্লোগান দিচ্ছে : মুনা

তাজিয়ার আদলে বুক চাপড়ে মাতম মিছিল

নারায়ণগঞ্জে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ২০২৪ সালের ১৭ জুলাইয়ের স্মৃতিচারণ করেছেন নারায়ণগঞ্জ জেলা ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি ফারহানা মানিক মুনা।

বৃহস্পতিবার (১৭ জুলাই) আন্দোলনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একথা বলেন মুনা।

তিনি বলেন, ১৬ জুলাই রাত ছিলো আমাদের জন্যে দুশ্চিন্তায় ভরা রাত। একদিকে ছাত্রলীগের হামলার নানাবিধ প্রস্তুতির খবর, অন্যদিকে জমায়েত ভাবনা। আমরা আমাদের দিক থেকে স্পষ্ট ছিলাম। আমরা ভেবেছিলাম, যা-ই হোক, মাঠ ছাড়া যাবে না। সাঈদের দুই হাত খুলে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানোর দৃশ্য দেখে বিশ্বাস করছিলাম, কিছু হতে যাচ্ছে। ফলে হবার আগ পর্যন্ত মাঠটাকে শক্ত করে দখলে রাখতে হবে।

আমরা প্রেসক্লাবে জড়ো হবো। যদি সম্ভব না হয়, তাহলে প্ল্যান-বি হচ্ছে আশুরার তাজিয়া মিছিল!অনেকটা গেরিলা উপায়ে তাজিয়া মিছিলে নিজেরা একত্রিত হয়ে সেখান থেকে নিজেদের মিছিল বের করা।

১৭ তারিখ সকাল ৯টায় প্রেসক্লাবের সামনে যাই।আগের রাতের সকল ভাবনা-চিন্তা বদলে যায়।কত কলেজ, কত স্কুলের শিক্ষার্থীদের দেখা পাই তার হিসেব নেই। আইডিয়াল স্কুল, প্রিপারেটরি স্কুল, না.গঞ্জ হাইস্কুল, আদর্শ স্কুলের ছোট্ট এই কিশোরদের শক্তি-সাহসে আমরা এখন হাজারে হাজার। মিছিল শুরু হয়, আমাদের প্রাণের মিছিল।স্লোগানের গমগম শব্দে পুরো নারায়ণগঞ্জ শহর একাকার। চারপাশে শুধু একই কথা "আমার ভাই মরলো কেনো? খুনি হাসিনা, জবাব চাই!"

মিছিল নিয়ে আগাই দুই নম্বর গেট হয়ে। ডিআইটি পৌঁছাতেই রাসেল পার্কের সামনে থেকে একটা মিছিল এসে মিশে যায় আমাদের মাঝে। যেন শরীরে নতুন শক্তি তৈরি হওয়া। সেই মিছিলে যুক্ত হয় সাফা, জুনায়েদ, জিসানেরা। হ্যাঁ, জিসান যে এখন প্রায় ৬৫+ দিন বিনা অপরাধে কারাবাস করছে।

মিছিল ঘুরে আমরা প্রথমে রেলপথ ব্লকেড ঘোষণা করি। নারায়ণগঞ্জে ঘটা প্রথম রেলপথ ব্লকেড এটি। দুই নম্বর গেট রেললাইনের উপর বসে পড়ে আমাদের নারী যোদ্ধারা। স্লোগান চলছে পুরো রাস্তা জুড়ে। আইল্যান্ডের উপর দাঁড়িয়ে আশপাশের দোকানিদের কাছে সমর্থন চাইলাম, সাথে চাইলাম ইন্টারনেট সংযোগ।

মুহূর্তেই সকলের সমর্থন টের পেলাম দোকানগুলোর ওয়াই-ফাইয়ের রূপে। কেউ পানি নিয়ে আসলো। একজন বাবার সাথে দেখা হয়েছিলো সেদিন। তার মেয়ের নামটা মনে নেই। বাবা তার মেয়ের হাতটা আমার হাতে দিয়ে বললো,"নিরাপত্তা পাই না, তাই সাথে আসছি। তোমাদের সাথে আছি।" তাকে সালাম করে বললাম, "আপনারা আছেন তা জানি। জানি বইলাই সাহস পাই।"

এদিকে আগের রাতেই ছাত্রদলের কয়েকজনের সাথে কথা হয়েছিলো। যদিও ১৪ তারিখ থেকেই আমাদের সাথে ছিলো ছাত্রদলের সিফাত। হামলার নানান খবর আসছিলো। ছাত্রদলের একটা টিমের কাছে বলেছিলাম, "১৫ বছরের কষ্টের ফায়সালার সময়। কলেজ রোড থেকে যেন কেউ চাষাঢ়া না ঢুকে।" যা বলা, তা-ই কাজ। কারণ, আমরা সেখানে ভিন্ন মতের হয়েও ভিন্ন দলের ছিলাম না!

ট্রেন আটকে ব্লকেড থেকে মিছিল নিয়ে চাষাঢ়া চত্বরে পৌঁছাই। আহা, কী সে রূপ চাষাঢ়ার। শামীম ওসমানের রাজত্বের বুকের উপর দাঁড়িয়ে ১৮/২০/২২ বছরের ছেলেমেয়ে স্লোগান দিচ্ছে। গলা ছেড়ে বলছে "দেশটা কারো বাপের না!" আহা, কী রূপ!

সেদিন সাঈদ, ওয়াসিমদের জন্য গায়েবানা জানাজা ছিলো দেশজুড়ে। আমরা চাষাঢ়া চত্বরেই তা করি। ইসলামি ছাত্র সংগঠনের সাথে কথা বলি জানাজা বিষয়ে। তারা বলেন, "এসব ধর্মবিরোধী।"
আমি বললাম, "আমরা ধর্মীয় নয়, রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করবো।" তারা দ্বিমত করেনি বরং একই সুরে সেদিন জানাজা-দোয়া হয়েছিলো। জানাজায় নারীদের উপস্থিতি নিষিদ্ধ। আমরা নারীরা জানাজার সারিতে দাঁড়াইনি। দাঁড়িয়েছিলাম সেই জানাজার চারপাশ ঘিরে। কেউ যেন হামলে পড়তে না পারে।

এ সবকিছুর ভিড়ে সময় হয় তাজিয়ার। আমার বন্ধু সময় মনে করিয়ে দেয়। তখনই মিনারে আমাদের অমল দা মানে সমগীতের অমল আকাশের সাথে আলাপ। ও পুরো মিছিলটার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হলো। সেই মিছিলে দাদার উদ্যম ছিল অনন্য।  সাথে সাথেই আয়োজন শুরু হয়। হাতে সময় কম, কিন্তু হাতের সব টাকা পানি, স্যালাইন ইত্যাদিতে শেষ। তরিক ভাই হাতে টাকা দেন তা দিয়েই ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের আসিফকে দেই। সে দৌড়ে যায় কালো কাপড় কিনতে। বন্ধুর কাছ থেকে টাকা নিয়ে সৃজয়কে দেই। সে যায় রঙ কিনতে। তখনই সামনে আসে জাহিদ হৃদয়। সে পিচঢালা রাস্তায় রঙ দিয়ে লিখছিলো। তাকে প্ল্যান বলতেই, হাতে রঙের ডিবিটা নিয়ে দাঁড়িয়ে লোক ডাকতে থাকে বুকে লেখার জন্য। সাঈদুর, সিয়ামদের বুকে লেখা হয়
"হায় সাঈদ", "হায় ওয়াসিম", "হায় রাফি"।

মিনারে দাঁড়িয়ে সুমিতের সহযোগিতায় প্রস্তুত হয় শোকের কালো ব্যানার আর মাথায় বাঁধার ফেট্রি।অমলদার বুকে লেখা হয় "হায় সাঈদ"। আমরা তাজিয়ার আদলে বুক চাপড়ে শুরু করি আমাদের মাতম মিছিল। অমলদা, সাঈদুরদের "হায় সাঈদ", "হায় ওয়াসিম", "হায় রাফি" আর্তনাদে শহর যেন কাঁপছিলো। চারিপাশে "হায় সাঈদ", "হায় রাফি", "হায় আদনান", "হায় ওয়াসিম"। নারী-পুরুষ, হিন্দু-মুসলিম সবাই জড়ো হয়েছিলাম একই প্রান্তে।
একই মাতমে! একই আর্তনাদে! ভাই হারানোর জবাব চেয়েই ঘোষণা হয় পরবর্তী দিনের কর্মসূচি।

জুলাই অভ্যুত্থানের বছরপূর্তিতে আমরা শপথ করছি একাত্তরের আকাঙ্ক্ষা এবং জুলাইয়ের আত্মত্যাগকে কেউ ধ্বংস করতে পারবে না। কেউ যদি আকাঙ্ক্ষার সেই পতাকা নামিয়ে দেয় কোনো না কোনো তরুণ সেই পতাকা আবার তুলে ধরবে।আবারও এ দেশের মুক্তিকামী মানুষ বুকের পাঁজর দিয়ে অন্যায়-জুলুমের বিরুদ্ধে ব্যারিকেড গড়ে তুলবে।আজ নয়তো কাল আমরা সেই বাংলাদেশ গড়বই। যে বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষা ছিল একাত্তরে,এবং যা গর্জে উঠেছিল জুলাইয়ে।