
ফাইল ছবি
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের উত্তাল ঢাকায় তখন উত্তেজনার পারদ চরমে। আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের রাজপথে যখন হাজারো শিক্ষার্থী ন্যায্য অধিকারের দাবিতে স্লোগান দিচ্ছেন, ঠিক সেই সময় এক নিরপরাধ মানুষ গুলিবিদ্ধ হন নামাজ শেষে বাসায় ফেরার পথে।
তিনি মনির হোসেন, বয়স ৫৪। পেশায় কেয়ারটেকার, একজন বাবা, একজন স্বামী- আর আজ, বাংলাদেশের জুলাই আন্দোলনের এক নীরব শহীদ।
ঘটনার দিন কী ঘটেছিল?
সেদিন দুপুরে স্বাভাবিকভাবেই খাবার খেয়ে কাজে বের হয়েছিলেন মনির হোসেন। বিকেলে আসরের নামাজ পড়তে যান স্থানীয় মসজিদে। নামাজ শেষে, স্ত্রী নুরজাহানের জন্য পান কিনে বাসায় ফেরার পথে চিটাগাং রোডের হিরাঝিল এলাকায় সংঘটিত হয় সেই মর্মান্তিক ঘটনা।
সেখানে চলছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একটি মিছিল। হঠাৎ গুলির শব্দে এলাকা কেঁপে ওঠে। গুলিবিদ্ধ হন মনির হোসেন- নির্মমভাবে, অপ্রস্তুত অবস্থায়। তিনি ছিলেন আন্দোলনের কোনো অংশ নন, ছিলেন একজন পথচারী। তবুও রক্ষা পাননি।
প্রথমে তাকে নেওয়া হয় নারায়ণগঞ্জ খানপুর হাসপাতালে, পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ, এরপর ধানমন্ডি পপুলার হাসপাতাল। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি- ২২ জুলাই আইসিইউতে মৃত্যুবরণ করেন তিনি।
মনির হোসেন ছিলেন কুমিল্লার মনোহরগঞ্জ উপজেলার তালতলা দাদঘর এলাকার আমিন বাড়ির সন্তান। ঢাকায় থাকতেন পরিবারসহ। তিন সন্তান- একজন প্রবাসী, একজন বিবাহিত কন্যা, আর একজন বেকার পুত্র। তিনি ছিলেন পরিবারের একমাত্র ভরসা।
স্ত্রী নুরজাহান বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘তিনি যাওয়ার আগে বলেছিলেন, দেশের অবস্থা ভালো না- সবাই সাবধানে থাকো। অথচ তিনিই আর ফিরে এলেন না। আমার জন্য পান এনেছিলেন, কিন্ত সেই পান নয়, তার লাশই ফিরল আমাদের ঘরে।’
ছেলে সাব্বির হোসেন বলেন, ‘আমার বাবা ছিলেন আমাদের সব। তিনি চলে যাওয়ার পর আমরা ঢাকার বাসা ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে ফিরে এসেছি। কিন্তু সেখানে কোনো ঘর নেই, থাকছি চাচার ঘরের একটিমাত্র রুমে। অনেক কষ্টে আছি।’
শহীদ মনিরের মৃত্যুর পর পরিবারটি মানবেতর জীবনযাপন করছে। স্থানীয় প্রশাসন ও কিছু সংগঠন থেকে কিছু আর্থিক সহায়তা দেওয়া হলেও, তা স্থায়ী সমাধান নয়।
জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশন- ৫ লাখ টাকা, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী- ২ লাখ টাকা, আসিফ মাহমুদ (স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা)- ২ লাখ টাকা অনুদান, তবে পরিবারটির সবচেয়ে জরুরি চাহিদা একটি নিজস্ব ঘর এবং ছেলের জন্য একটি চাকরি।
ঘটনার পর, ২০ আগস্ট, নিহত মনির হোসেনের ছোট ভাই সাখাওয়াত হোসেন নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। প্রধান আসামি করা হয় নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের তৎকালীন সংসদ সদস্য এ.কে.এম. শামীম ওসমানকে। মামলায় ছাত্রলীগ, পুলিশ এবং আওয়ামী লীগ-সমর্থিত ১২৩ জনকে অভিযুক্ত করা হয়।
সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘শামীম ওসমানের নির্দেশেই ছাত্র ও সাধারণ জনতার উপর গুলি চালানো হয়। আমার ভাই ছিলেন পথচারী। তিনিও সেই হামলায় প্রাণ হারান।’
মনোহরগঞ্জ উপজেলার ইউএনও গাজালা পারভীন রুহি জানান, ‘আমরা শহীদ মনির হোসেনের পরিবারকে সহযোগিতার চেষ্টা করছি। ছেলের ঘরের আবেদন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। বরাদ্দ এলে ঘর করে দেওয়া হবে। অন্য সুযোগ-সুবিধাও বিবেচনায় রাখা হচ্ছে।’
মনির হোসেন ছিলেন না কোনো রাজনৈতিক কর্মী, ছিলেন না আন্দোলনকারীও। তবুও গুলি বিদ্ধ হয় তার শরীরে। বাংলাদেশের জুলাই আন্দোলন শুধু রাজনৈতিক নয়, তা হয়ে দাঁড়িয়েছে জনগণের জীবনের এক অংশ, যেখানে শহীদ হচ্ছেন একেকজন নিরীহ মানুষ- যারা কোনো ভোরে ফিরে আসার কথা থাকলেও, ফিরেন লাশ হয়ে।
‘আমি শুধু ঘর চাই না, বাবার মৃত্যুর বিচার চাই’-এই কথা যেন অন্ধকারে আলো হয়ে বাজে প্রতিটি বিবেকবান মানুষের হৃদয়ে।