বুধবার, ১৬ জুলাই ২০২৫

|

আষাঢ় ৩১ ১৪৩২

Advertisement
Narayanganj Post :: নারায়ণগঞ্জ পোস্ট

৫৪ হাজার কোটি টাকার কাপড় ঢোকে চোরাইপথে

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

প্রকাশিত: ১২:১৩, ১৬ জুলাই ২০২৫

৫৪ হাজার কোটি টাকার কাপড় ঢোকে চোরাইপথে

ফাইল ছবি

প্রতিবছর ভারত থেকে চোরাই পথে ৫৪ হাজার কোটি টাকার শাড়ি-কাপড় বাংলাদেশে ঢুকছে। সীমান্তবর্তী এলাকার কিছু সিন্ডিকেট কাস্টমসের অসাধু কর্মকর্তাদের সঙ্গে আঁতাত করে শুল্ক ছাড়াই এসব কাপড় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নিয়ে আসে। পরে কুরিয়ার সার্ভিসে রাজধানীর নামকরা সব শপিং মলে পৌঁছে দেয়। পার্সেল গ্রহণের পর সেই কাপড়ের টাকা হুন্ডির মাধ্যমে পরিশোধ করা হয়। একই কায়দায় বন্ড সুবিধায় আনা সুতাও ক্রেতার সুবিধাজনক গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার আরেকটি সিন্ডিকেট রয়েছে। নারায়ণগঞ্জ, কেরানীগঞ্জ ও নরসিংদীতে এই সিন্ডিকেটের অর্ধশতাধিক অস্থায়ী গোডাউন রয়েছে। বন্ডের সুতা ও চোরাই পোশাকের অবাধ প্রবেশের কারণে দেশীয় টেক্সটাইল শিল্প প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমন চঞ্চল্যকর তথ্য। সম্প্রতি প্রতিবেদনটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। প্রতিবেদনে শাড়ি-কাপড় আনার চোরাই প্রক্রিয়া, রাজধানীর কোন কোন মার্কেটে এসব কাপড় বিক্রি হয়; বন্ডের সুতা-ডাইস, কেমিক্যাল ও ফেব্রিক্স কোন কোন মার্কেটে বিক্রি হয়-এসব বিষয়ে বিস্তারিত বিবরণ উল্লেখ করা হয়েছে। 

রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক শিল্পকে সহায়তা করতে বন্ড সুবিধা দিয়ে আসছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। বন্ড সুবিধায় বর্তমানে নিট ফেব্রিক্স, ওভেন ফেব্রিক্স, ডেনিম ফেব্রিক্স, ম্যাশ ফেব্রিক্স, জার্সি কাপড়, কটন সুতা, পলিয়েস্টার সুতা, নাইলন সুতা, রাবার সুতা, কালি, সিনথেটিক ডাইস, সালফার ডাইস, বেস কালার, ডুপ্লেক্স বোর্ড, পলিপ্রোপাইন, গাম টেপ, এডহেসিভ টেপ, টিস্যু পেপার, আর্ট কার্ড, কার্ড বোর্ড, টেক্সটাইল শিল্পের এমিনো সিলিকন অয়েল, হাইড্রোজেন পার অক্সাইড, কস্টিক সোডা, ফিনিসিং এজেন্ট, অ্যাসিটিক অ্যাসিড, ইন্ডাস্ট্রিয়াল লবণ, সোডিয়াম সালফেট, রেসিস্ট সল্ট, বিভিন্ন প্রকার লেবেলিং আইটেম, ইলাস্টিক, হ্যাঙ্গার, জিপার, বাটন, ব্লেজার/জ্যাকেট তৈরির প্যাডিংসহ তৈরি পোশাক শিল্পের কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী কাঁচামাল আমদানি হয়ে থাকে।  

গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বন্ড সুবিধায় আমদানীকৃত শুল্কমুক্ত ফেব্রিক্স, সুতা, অন্য কাঁচামাল ও এক্সেসরিজ রপ্তানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানের ওয়্যারহাউজে প্রবেশের আগেই বিভিন্ন ব্যবসায়ীর হাতে চলে যাচ্ছে। ফলে সরকার বিপুল অঙ্কের রাজস্ব হারানোর পাশাপাশি ব্যবসার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। এছাড়া বন্ডেড সুবিধায় আমদানীকৃত পণ্য অবৈধভাবে খোলাবাজারে বিক্রয় এবং চোরাচালানের মাধ্যমে দেশে আসা পণ্যের সঙ্গে দেশীয় পণ্য প্রতিযোগিতায় টিকতে না পারায় অনেক দেশীয় কারখানা বন্ধসহ শ্রমিক বেকার হয়ে যাচ্ছেন। এতে আরও বলা হয়, বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় কিছু চোরাকারবারি গ্রুপ চোরাই পথে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে ভারত থেকে শাড়ি-কাপড় এনে ঢাকার বিভিন্ন মার্কেটে সরবরাহ করে। সারা বছর অল্প অল্প পরিমাণে কাপড় আনা হলেও ঈদ ও পূজার আগে চোরাকারবারিরা সক্রিয় হয়ে ওঠে। তখন চোরাচালান বহুগুণ বেড়ে যায়। 

এ বিষয়ে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সহসভাপতি সালেহউদ জামান যুগান্তরকে বলেন, ঢাকার ছোট-বড় শপিং মলগুলোতে যেসব থ্রি-পিস বিক্রি হয়, তার ৬০ ভাগই ভারতীয়। আর নরসিংদীর মাধবদী, কালিবাড়ি, নারায়ণগঞ্জের টানবাজারে বিদেশি সুতা বিক্রি হয়। কিন্তু এনবিআরের তথ্য বলছে, এসব সুতা ডিউটি-ট্যাক্স দিয়ে আনা হয়নি। তাহলে এসব সুতা বাংলাদেশে প্রবেশ করল কীভাবে? তিনি আরও বলেন, ভারতীয় পোশাক বা বন্ডের সুতা-কাপড়ের সমস্যাগুলো চিহ্নিত। সবাই এসব বিষয় সম্পর্কে জানে। কিন্তু এ বিষয়ে এনবিআর নির্বিকার। দীর্ঘদিন যাবৎ শুল্ক গোয়েন্দা বা বন্ড কমিশনারেটকে অবৈধ সুতা বা কাপড়ের বিষয়ে অভিযান চালাতে দেখা যাচ্ছে না। সরকার যদি টেক্সটাইল শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে চায়, তাহলে দ্রুততার সঙ্গে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। তা না হলে নিকট ভবিষ্যতে ছোট মিলগুলো এবং একটা সময় বড় মিলগুলো অসম প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে বন্ধ হতে বাধ্য হবে। 

ঢাকার আশপাশে বন্ডের সুতা-ফেব্রিক্সের গোডাউন: রাজধানীর আশপাশে নারায়ণগঞ্জ, কেরানীগঞ্জ ও নরসিংদীতে বাসা-বাড়িতে বন্ডের সুতা ও ফেব্রিক্সের অস্থায়ী গোডাউন গড়ে উঠেছে। বন্ড সুবিধায় আনা সুতা, কাপড় চট্টগ্রাম বন্দর থেকে খালাস করে রাতের আঁধারে ট্রাকে করে এসব গোডাউনে নিয়ে আসা হয়। নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ড ও চিটাগাং রোডের আশপাশের অনেক বাড়িকে অস্থায়ী গোডাউন হিসেবে ব্যবহার করে চোরাকারবারিরা। এসব গোডাউন থেকে সুবিধাজনক সময়ে রাজধানীর ইসলামপুরে এবং দেশের প্রান্তের কারখানায় বন্ডের সুতা-কাপড় পৌঁছে দেওয়া হয়। 

গোয়েন্দা প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ভারত ও চীন থেকে বন্ড সুবিধায় আনা পণ্য প্রথমে চট্টগ্রামের টেরিবাজারে জাহাজ থেকে আনলোড করা হয়। এসব পণ্য ওয়্যারহাউজে না নিয়ে সরাসরি ঢাকা ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন মার্কেটে পাঠানো হয়। এছাড়া নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ড ও চিটাগাং রোডের অস্থায়ী গোডাউনে রাখা হয়। পরে ভ্যানযোগে এসব মালামাল ঢাকায় পাঠানো হয়। তাছাড়া বিভিন্ন কোম্পানির ওয়্যারহাউজ থেকে কাপড় বোঝাই ট্রাক রাত ১২টার পরে সরাসরি ইসলামপুর ও সদরঘাটে পৌঁছে দেওয়া হয়। ইসলামপুরের নূর ম্যানশন, সাউথ প্লাজা, গুলশান আরা সিটি, মনসুর ক্যাসেল, হাবিবুল্লাহ মার্কেট, ইসলাম প্লাজা, সদরঘাটের বিক্রয়পুর সিটি গার্ডেন মার্কেটে রাতের আঁধারে চলে পণ্য খালাস। 

পাথরবোঝাই ট্রাক-ট্রলারে ঢুকছে ভারতীয় শাড়ি-কাপড়: ভারত থেকে স্থল, নৌ এবং আকাশপথে প্রতিবছর ৫৪ হাজার কোটি টাকার শাড়ি-কাপড় বাংলাদেশে ঢুকছে। নৌ ও স্থলপথে থান কাপড়, শাড়ি, লেহেঙ্গা, পাঞ্জাবি ও তৈরি পোশাক ৩ ধাপে আনা হয়। প্রথমে ভারতের আহমেদাবাদ থেকে ভারতীয় এজেন্টরা করিমগঞ্জ ও আগরতলায় এসব কাপড় পৌঁছে দেয়। একই কায়দায় কলকাতা থেকে স্থলপথে বেনাপোল, চুয়াডাঙ্গা ও সাতক্ষীরার বিভিন্ন পয়েন্টে পৌঁছে দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশি অংশের সিন্ডিকেট সদস্যরা পাথরবোঝাই ট্রাকের পাথরের নিচে চাপা দিয়ে অথবা নৌপথে ট্রলারের মাধ্যমে বাংলাদেশে আনা হয়। সর্বশেষ কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে পার্সেল আকারে সেসব শাড়ি-কাপড় রাজধানীর মার্কেটে পাঠানো হয়। কাপড়ের টাকা পরিশোধ করা হয় হুন্ডির মাধ্যমে। গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা ভারতের কলকাতা বা অন্য এলাকায় গিয়ে শাড়ির নকশা পছন্দ করে আসেন। এরপর চালান প্রস্তুত হলে প্রক্রিয়াতে যুক্ত হয় মধ্যবর্তী এজেন্টরা। এই এজেন্টরা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে শাড়ি পরিবহন করে বাংলাদেশের বিভিন্ন গন্তব্যে পৌঁছে দেয়। গোটা প্রক্রিয়ায় লেনদেন হয় হুন্ডির মাধ্যমে। 

এতে আরও বলা হয়, রাজধানীর নামকরা মার্কেটের সব বড় দোকানের প্রত্যেক কর্মচারীর পাসপোর্ট রয়েছে। এসব কর্মচারী প্রতি মাসে একাধিকবার ভারতে যায়। তাদের ভারত যাওয়ার আগেই কলকাতায় ভারতীয় এজেন্টরা পণ্য ব্যাগ আকারে প্রস্তুত করে রাখে। এসব কর্মচারী সন্ধ্যা নাগাদ ভারতে পৌঁছে খরচ বাঁচাতে হোটেলে না উঠে সিনেমা দেখে, স্টেশনে রাত্রিযাপন করে এবং পরদিন সকালে লাগেজসহ বাংলাদেশে প্রবেশ করে। আবার কিছুসংখ্যক ভারতীয় চোরাকারবারি দুই দেশের সীমান্তরক্ষীদের ফাঁকি দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে ওইসব এলাকার কুরিয়ার সার্ভিসে পণ্য পৌঁছে দেয়।  

সীমান্ত হাটের মাধ্যমে চোরাচালানের তথ্য তুলে ধরে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সীমান্ত হাটের দিনে সংশ্লিষ্ট সীমান্ত হাট এলাকার মহিলাদের দৈনিক ১৫-২০ বার পাঠিয়ে কাপড় ভর্তি ব্যাগ কার্গোতে তুলে দেয়া হয়। হাটের দিনে ৫০ থেকে ২০০ ডলারের মালামাল আনার আইন থাকলেও বিজিবি ও বিএসএফকে ম্যানেজ করে অতিরিক্ত পোশাক বাংলাদেশে নিয়ে আসে চোরাকারবারিরা। 

বন্ড সুবিধা অপব্যবহারের কৌশল: দশ পৃষ্ঠার গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বন্ড সুবিধার অপব্যবহার পদ্ধতির বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, কতিপয় গার্মেন্টস মালিক বেশি পরিমাণে অপচয় দেখিয়ে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি কাপড় আমদানি করে। পরে তা অন্য ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দেয়। একটি শার্ট বানাতে ৩০ শতাংশ কাপড়ের অপচয় ধরা হয়। আবার কাপড়ের স্যাম্পল পরিবর্তন করে দামি কাপড় নিয়ে আসে। কাস্টমসের অসাধু কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে এসব কাপড় খালাস নেওয়া হয়। ওজনে কারচুপি আরেকটি পদ্ধতি। সুতা আনার ক্ষেত্রে কাউন্ট (গ্রেড) পরিবর্তন করা হয়। ৩০ কাউন্ট ঘোষণা দিয়ে ৮০ কাউন্টের সুতা এনে সেগুলো নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, সিদ্ধিরগঞ্জের অস্থায়ী গোডাউনে রেখে বিভিন্ন কারখানায় রাতের আঁধারে সরবরাহ করা হয়।   

বন্ডের অপব্যবহারের কারণে ৭টি সমস্যা চিহ্নিত করা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে। প্রথমত; অসম প্রতিযোগিতা এবং বাজারে অস্থিতিশীলতা তৈরি হচ্ছে। এতে স্থানীয় শিল্পের ব্যবসার ‘ফেয়ার প্লে গ্রাউন্ড’ নষ্ট হচ্ছে। দ্বিতীয়ত; চোরাচালানের মাধ্যমে আসা পোশাকের ওপর শুল্ক ও ভ্যাট আদায় করতে না পারায় সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে। তৃতীয়ত; স্থানীয় শিল্প-কারখানা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। কারণ চোরাচালানিরা কম দামে পোশাক নিয়ে এসে দেশীয় উৎপাদকদের চেয়ে কম দামে বাজারে বিক্রি করছে। এতে দেশীয় পোশাক শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। চতুর্থত; বন্ডের সুবিধায় আমদানীকৃত গার্মেন্টস পণ্য ও চোরাচালানের পোশাক খোলাবাজারে বিক্রি হওয়ায় ব্যবসায়ীদের কাঙ্ক্ষিত মুনাফা হচ্ছে না। ফলে তারা নতুন বিনিয়োগে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। পঞ্চম; এসব কারণে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেক শ্রমিক বেকার হয়ে যাচ্ছেন। এভাবে চোরাচালান বাড়লে পোশাক শ্রমিকদের কর্মসংস্থান আরও কমে যেতে পারে এবং এ কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতি ঘটতে পারে বলে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া চোরাচালানের মাধ্যমে আনা পোশাকের মূল্য হুন্ডিতে পরিশোধ করা হচ্ছে, যা অর্থপাচারকে ত্বরান্বিত করছে। পাশাপাশি চোরাচালানের মাধ্যমে পণ্য আসায় বৈদেশিক মুদ্রা আয় হ্রাস পেয়েছে।