
ফাইল ছবি
বছর ঘুরে আবারও জুলাইয়ে নারায়ণগঞ্জবাসী। কোটা সংস্কারের দাবীতে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের গণ-অভ্যুত্থানে রুপ নেয়ার পুরে সময়জুড়েই অগ্নিগর্ভ ছিল নারায়ণগঞ্জ। আন্দোলনের উত্তাল সেই দিনগুলোর কথা ভাবতেই গা শিউরে ওঠে অনেকের, আন্দোলনে সম্মুখ যোদ্ধাদের কাছে এই আন্দোলন গৌরবের। আন্দোলনে যারা নিজের সন্তান ও স্বজনদের হারিয়েছেন তাদের কাছে এই আন্দোলন এক দুর্বিষহ স্মৃতি।
নারায়ণগঞ্জে মূল আন্দোলন শুরু হয় ১৮ জুলাই থেকে। ৫ আগস্ট বিজয় অর্জনের আগ পর্যন্ত চলে এ লড়াই। তবে ১৫ জুলাই আন্দোলনের দানা বাঁধা শুরু হয়। ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো এখনো নাড়া দেয় নারায়ণগঞ্জবাসীকে।
১৫ জুলাই, সোমবার
মূলত জুলাই মাসের ১৫ তারিখ থেকেই নারায়ণগঞ্জে দানা বাঁধতে শুরু করে আন্দোলন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন স্থানে ছাত্র জনতার উপর হামলার প্রতিবাদে নারায়ণগঞ্জে মশাল মিছিল করে শিক্ষার্থীরা। শহরের চাষাঢ়া এলাকা থেকে শুরু করে বঙ্গবন্ধু সড়ক অতিক্রম করে প্রেসক্লাবের সামনে এসে মিছিলটি শেষ হয়। তবে এদিন কোন সংঘাত সংঘর্ষ হয়নি।
১৬ জুলাই, মঙ্গলবার
এদিক নারায়ণগঞ্জে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করে ছাত্র জনতা। শহরের প্রানকেন্দ্র চাষাঢ়া এলাকায় কয়েক হাজার শিক্ষার্থী অবস্থান নেয়। এসময় স্লোগানে উত্তাল হয়ে উঠে পুরো এলাকা। নারায়ণগঞ্জ শহরের বাইরেও সাইনবোর্ড, সোনারগাঁয়ে বিক্ষোভ হয়। এক পর্যায়ে সোনারগাঁয়ে মহাসড়ক অবরোধ করে রাখেন বিক্ষোভকারীরা।
এদিকে আন্দোলনকারীদের দমন করতে দিনভর শহরের তোলারাম কলেজে ও আশেপাশের এলাকায় অবস্থান নেন ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা। বিকেলের পর আন্দোলনকারীরা চাষাঢ়া ত্যাগ করলে মিছিল নিয়ে শহরজুড়ে মহড়া দেয় ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা।
এদিকে দেশব্যাপী আন্দোলন যখন তুঙ্গে সেসময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শামীম ওসমানের অসুস্থতার খবর ছড়িয়ে দেয়া হয়। ঢাকার একটি হাসপাতালে অসুস্থ হয়ে ভর্তি হন শামীম ওসমান। শামীমের ছবি পোস্ট করে তার জন্য সকলের কাছে দোয়া চান অয়ন ওসমান।
১৭ জুলাই, বুধবার
নারায়ণগঞ্জে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের সতর্ক অবস্থানে থাকার নির্দেশ দেন অয়ন ওসমান। এদিনও নারায়ণগঞ্জ শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সশস্ত্র অবস্থান নেন। তবে ছাত্রলীগের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করেই এদিন মাঠে নামে শিক্ষার্থীরা।
এদিন সকালে দেশের বিভিন্ন স্থানে পুলিশের গুলিতে নিহত শিক্ষার্থীদের গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজা শেষে শহরে কফিন মিছিল বের করেন শিক্ষার্থীরা। গায়েবানা জানাজার নামাজ আদায় করে বিএনপি ও অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের নেতাকরমিরাও। এদিন তৎকালীন মহানগর বিএনপির আহবায়ক অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খান, মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব আবু আল ইউসুফ খান টিপু, জেলা যুবদলের সদস্য সচিব মশিউর রহমান রনিসহ অনেকেই শহরের চাষাঢ়ায় গায়েবানা জানাজা আদায় করেন নেতাকর্মীদের নিয়ে। মিছিল শেষে শহরের প্রানকেন্দ্র চাষাঢ়ায় সড়ক অবরোধ করেন ছাত্র জনতা। নারায়ণগঞ্জ শহরের বাইরেও কাঁচপুর, লিংক রোডের জালকুড়ি ও সাইনবোর্ড এলাকায় অবরোধ করে ছাত্র জনতা।
একই সাথে আশুরাকে কেন্দ্র করে এর মাঝে এদিন শহরে নিহত ছাত্রদের নাম গায়ে লিখে খালি গায়ে তাজিয়া মিছিল করে শিক্ষার্থীরা। বিক্ষোভের এক পর্যায়ে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটের ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দেয় ছাত্র জনতা। এসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের নিয়ে দেয়া জাফর ইকবালের বক্তব্যের প্রতিবাদে তার বই পুড়িয়ে প্রতিবাদ জানান শিক্ষার্থীরা।
এদিন দিনভর আন্দোলনে উত্তাল ছিল নারায়ণগঞ্জ। তবে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের সাথে শিক্ষার্থীদের কোন সংঘাতের ঘটনা ঘটেনি। রাতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আসনটির তৎকালীন এমপি শামীম ওসমান সুস্থ রয়েছেন বলে জানান তার ছেলে অয়ন ওসমান। একই সাথে আন্দোলনকে নাশকতা উল্লেখ করে ছাত্রলীগ, যুবলীগ, আওয়ামীলীগকে তা প্রতিরোধের নির্দেশ দেন।
১৮ জুলাই, বৃহস্পতিবার
আন্দোলনকারীদের উপর পুলিশ লাঠিচার্জ টিয়ারগ্যাস ও গুলি ছুড়লে পুলিশের গাড়ি ভাঙে আন্দোলনকারীরা। এ ঘটনার পর উত্তপ্ত হতে শুরু করে নারায়ণগঞ্জ। এর আগের কয়েকদিনের মতো এদিনও বেলা ১১টায় শহরের প্রাণকেন্দ্র চাষাঢ়া ও দুই নম্বর রেলগেইটে পূর্বঘোষণা অনুযায়ী জড়ো হন আন্দোলনকারীরা। দুপুর ১টার দিকে আন্দোলনকারীদের দমাতে পুলিশ টিয়ারগ্যাস ও গুলি ছুড়লে চাষাঢ়ায় পুলিশের দুটি গাড়ি ভাঙচুর করা হলে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এ সময় পুলিশ আন্দোলনরতদের উপর জলকামান টিয়ারশেল ও গুলি নিক্ষেপ করে।
অন্যদিকে, আন্দোলনকারীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। বিকাল পর্যন্ত চলে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া। ছাত্র জনতার উপর বিকেলে সশস্ত্র হামলা চালায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এর মাঝে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ বিশাল মিছিল নিয়ে শহরের ডিআইটি থেকে চাষাঢ়ান এলে তাদের সাথে ছাত্রলীগের সংঘর্ষ হয়।
এর জেরে সন্ধ্যার পর থেকেই বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপক আকারে প্রতিক্রিয়া দেখায় নারায়ণগঞ্জের ছাত্র-জনতা। প্রতিক্রিয়ায় টিয়ারগ্যাস ও গুলি করে ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করলেও আন্দোলন দমেনি। ব্যাপক গুলি করা হয় সাইনবোর্ড এলাকায়। এক পর্যায়ে গুলি শেষ হয়ে গেলে পুলিশ পিছু হটে। ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয় জেলা পিবিআই কার্যালয়, আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস, শহরের দুই নম্বর রেলগেটের পুলিশ বক্স, জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের অফিস।
১৯ জুলাই, শুক্রবার
শুক্রবার সকাল থেকেই জেলাজুড়ে বিরাজ করছিল থমথমে অবস্থা। জেলার সাইনবোর্ড, চিটাগাংরোড, জালকুড়ি, ভূঁইগড়, চাষাঢ়াসহ বেশকিছু স্পটে দলবেঁধে অবস্থান নেয় আন্দোলনকারীরা। কোথাও সড়ক বিভাজকের কিছু অংশ তুলে, কোথাও গাছ ফেলে সড়কে অবরোধ তৈরি করা হয়। এদিন লিংক রোড, চাষাঢ়া, জালকুড়ি, দেওভোগে শামীম ওসমানের নেতৃত্বে সশস্ত্র হামলা চালানো হয় আন্দোলনকারীদের উপর। মুহু মুহু গুলি চালায় তারা আন্দোলনকারীদের উপর। এক পর্যায়ে তাদের গুলি ফুরিয়ে এলে ছাত্র-জনতা দখলে নেয় রাজপথ।
বিকাল ৪টা পর্যন্ত চলে সংঘর্ষ। আন্দোলনকারীদের উপর নির্বিচারে গুলির ফলে ফুঁসে উঠে নারায়ণগঞ্জ। এর তীব্র প্রতিক্রিয়ায় গুলি চালানো শামীম ওসমানের ক্যাডার শাহ নিজামের মালিকানাধীন ফতুল্লায় অবস্থিত নাসিম ওসমান মেমোরিয়াল পার্ক (নম পার্ক), গুলি চালানোর আগে নেতাকর্মীদের জড়ো করা ক্যান্টনমেন্টখ্যাত নারায়ণগঞ্জ ক্লাব, আন্দোলনকারীদের উপর গুলি চালানো রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠান এসবি গার্মেন্টসহ আরো বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। জালকুড়িতে শামীম ওসমানের মালিকানাধীন বাস কোম্পানি শীতল পরিবহনের ডিপোতে বিক্ষোভ মিছিল করে শীতল পরিবহনের ২৬টি বাসে আগুন দেওয়া হয়।
২০ জুলাই, শনিবার
এদিন আন্দোলন দমাতে সারাদেশে কারফিউ জারি করা হয়। বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা করতে মোতায়েন করা হয় সেনাবাহিনীও। এর মাঝেই উত্তাল জনতা নারায়ণগঞ্জে টায়ার জ্বালিয়ে, গাছ ফেলে সড়কে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করার পাশাপাশি দুপুরে চিটাগাংরোড ও সাইনবোর্ড এলাকায় জড়ো হতে শুরু করে। চলে তাদের উপর হামলা ও গুলি। তবুও রাজপথেই ছিল আন্দোলনকারীরা।
এক পর্যায়ে যৌথ বাহিনীর সঙ্গে আন্দোলনকারীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। শিমরাইলের একটি মার্কেটের উপরে শিল্প পুলিশের কার্যালয় থেকে আন্দোলনকারীদের গুলি ছোড়া হলে সেখানে আগুন দেয় বিক্ষোভকারীরা৷ এতে ভবনটিতে আটকা পড়েন ৩৭ জন পুলিশ সদস্য। পরবর্তীতে হেলিকপ্টার দিয়ে ৩৭ পুলিশ সদস্যকে উদ্ধার করে র্যাব।
এদিন বিজিবি ক্যাম্পের অদূরে যৌথ বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে অন্তত চারজন নিহত ও ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কে গুলিবিদ্ধসহ প্রায় ২০০ জন আহত হন। এদিন হেলিকপ্টার থেকে সাইনবোর্ড ও চিটাগাং রোড এলাকায় আন্দোলনকারীদের উপর গুলি চালানো হয়।
২১ জুলাই, রোববার
এদিনও উত্তপ্ত ছিল নারায়ণগঞ্জ। বিশেষত ঢাকার প্রবেশমুখ চিটাগাংরোড ও সাইনবোর্ডে এদিনও সকাল থেকে বিক্ষোভকারীদের অবস্থান ছিল ব্যাপক। দুপুরে যৌথ বাহিনী অভিযান শুরু করে এসব এলাকায়। এতে দফায় দফায় চলে ব্যাপক সংঘর্ষ।
২২ জুলাই, সোমবার
ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কে এদিন সংঘর্ষ অব্যাহত থাকে। এসময় ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কের আশেপাশের হাসপাতালগুলোতে আহত মানুষের ব্যাপক ভীড় দেখা যায়। এসকল আহতদের বেশিরভাগেরই সাথে ছিলনা টাকা, ছিলনা কোন আত্মীয় স্বজন। এক পর্যায়ে সেখানে প্রো এ্যাকটিভ হাসপাতালসহ প্রায় সবগুলোতে আন্দোলনকারীদের জন্য চিকিৎসা ফ্রী করে দেয়া হয়।
২৩ জুলাই, মঙ্গলবার
রাত থেকেই জেলাজুড়ে আন্দোলনকারীদের দমনে গ্রেপ্তার অভিযান শুরু হয়। অপ্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষার্থীদেরও রাস্তা থেকে ও বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। মোবাইল চেক করে আন্দোলনে ছবি, ভিডিও বা ফেসবুক পোস্ট দেখলেই গ্রোপ্তার করা শুরু করে পুলিশ। গ্রেপ্তার অভিযানের মূল টার্গেটে ছিল বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা এবং বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে অংশ নেয়া ছাত্র-জনতা।
২৬ জুলাই, শুক্রবার
এদিনও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জেলাজুড়ে ব্যাপক ধড়পাকড় চালায়। জেলার শীর্ষ বিএনপি নেতা থেকে শুরু করে তৃণমূল নেতাকর্মীরাও আত্মগোপনে চলে যায়। আত্মগোপনে থেকেই আন্দোলনে ছাত্র জনতাকে সহযোগিতা করে এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকেন তারা। পাশাপাশি সকল রাজনৈতিক দল ছাত্র-জনতার পাশে অবস্থান নেয়।
২৭ জুলাই, শনিবার
নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে আন্দোলনের সম্মুখ যোদ্ধা ছাত্রদল নেতা হীরাকে না পেয়ে এইচএসসি পরীক্ষার্থী ভাই আবু রায়হানকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যান পুলিশ। গ্রেপ্তারকৃত আসামিদের হাজতে ভয়ানক ভাবে টর্চার করা হয়।
একই দিনে বাড়ির ছাদে গুলিবিদ্ধ শিশু রিয়া গোপের মৃত্যু হয়। এই মৃত্যুর ঘটনা দেশবাসীকে ব্যাপক ভাবে নাড়া দেয়। এসব ঘটনায় আন্দোলন আরো তীব্র হয়।
২৮ জুলাই, রোববার
সকালে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের নগর ভবন পরিদর্শনে আসেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। এসময় মন্ত্রীর সামনে আন্দোলনকারীদের ঠেকানো পিওনদের সুপার হিরো বলে সম্বোধন করেন তৎকালীন মেয়র আইভী। এসময় আন্দোলন দমন করা নিয়ে শামীম ওসমানের একনিষ্ঠ কর্মী সন্ত্রাসী ডিশ বাবুর সাথে বিতর্কে জড়ান আইভী। সেদিন বাবু স্বীকার করেন তারা ছাত্র জনতার আন্দোলনে দমাতে শামীম ওসমানের নির্দেশে মাঠে কাজ করছেন।
২৯ জুলাই, সোমবার
নারায়ণগঞ্জের আদালতে এদিন হৃদয়বিদারক দৃশ্য দেখা যায়। আন্দোলনে আটক হওয়া যুবক ও কিশোরদের অনেককে এদিন আদালতে হাজির করা হয়। এসময় স্বজনদের আহাজারিতে পুরো আদালতপাড়া ভারি হয়ে উঠে।
৩০ জুলাই,মঙ্গলবার
নারায়ণগঞ্জে মহড়া শুরু করে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। নারায়ণগঞ্জে নেতাকর্মীদের সাথে সভা করেন শামীম ওসমান। এসময় দেশ বিরোধী সমস্ত শক্তি জাতির পিতার কন্যার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে বলে মন্তব্য করেন শামীম ওসমান। নেতাকর্মীদের আন্দোলন দমাতে সর্বশক্তি প্রয়োগের নির্দেশ দেন তিনি।
৩১ জুলাই, বুধবার
নারায়ণগঞ্জ শহরের বিভিন্ন দেয়াল দ্রোহের গ্রাফিতিতে ভরে উঠতে থাকে। রাত হতে হতে শহরের প্রায় সমস্ত রাস্তার দেয়ালে নানান রকমের বিদ্রোহী উক্তি লেখা দেখা যায়। একই দিন রাতে আন্দোলনে নিহতদের জন্য জাতীয় শোক দিবস ঘোষণা করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। হাসিনার শোককে প্রত্যাখ্যান করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ সব জায়গায় বিদ্রোহের লাল রং দেখিয়ে প্রতিবাদ জানায় ছাত্র জনতা।
৩২ জুলাই, বৃহস্পতিবার (১ আগষ্ট)
নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ জানায়, আন্দোলনে নাশকতার অভিযোগে ৬০০জনেরও বেশি গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এসকল ঘটনায় প্রায় ৩০ মামলা দায়ের করা হয়েছে। গ্রেপ্তারকৃতদের বেশিরভাগই ছিলেন বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা।
একই দিনে রূপগঞ্জে আন্দোলনে যাওয়ার অপরাধে ছাত্রদল নেতাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এঘটনায় দেশব্যাপী ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়।
আন্দোলনের অংশ হিসেবে এইচএসসি পরীক্ষা বর্জনের ডাক দেয় সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
এদিন সন্ধ্যায় কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে শিক্ষার্থীরা চাষাঢ়া কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মোমবাতি প্রজ্জ্বলন করতে যায়। এসময় শিক্ষার্থীদের পিটিয়ে শহীদ মিনার থেকে বের করে দেয় পুলিশ। চাষাঢ়া বালুর মাঠে পুলিশের সাথে আন্দোলনকারীদের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া হয়। ঘটনাটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে নারায়ণগঞ্জে আন্দোলন পুনরায় মাথা চাড়া দিয়ে উঠে।
৩৩ জুলাই, শুক্রবার (২ আগষ্ট)
নারায়ণগঞ্জে আন্দোলনে নিহত শিক্ষার্থীদের জন্য বিএনপি নেতাকর্মীরা দোয়া কামনা করে কর্মসূচি পালন করে। একই দিন শহরের চাষাঢ়া এলাকা থেকে গণমিছিল বের করেন ছাত্র-জনতা। নারায়ণগঞ্জ ছাড়াও সিদ্ধিরগঞ্জে গণমিছিল অনুষ্ঠিত হয়।
৩৪ জুলাই, শনিবার (৩ আগষ্ট)
দ্বিতীয় দিনের মত নারায়ণগঞ্জে গণমিছিল বের করে ছাত্র-জনতা। মিছিল শেষে চাষাঢ়া এলাকা অবরোধ করেন তারা। এসময় আন্দোলনে শহীদ মীর মুগ্ধের স্মরণে পানি বিতরণ করেন অনেকে।
এদিন দুপুর থেকে ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কের সাইনবোর্ড থেকে চিটাগাং রোড এলাকা দখলে নেয় বিএনপি ও অঙ্গ সহযোগী সংগঠন ও ছাত্র-জনতা। রাত ৯ টা পর্যন্ত পুরো দখলে রাখে তারা। পরে ধীরে ধীরে তারা অবস্থান কমালেও একেবারে সরে যায়নি।
এদিকে দিনভর আন্দোলনে উত্তাল নারায়ণগঞ্জ শহর ছিল ছাত্র জনতার দখলে। সন্ধ্যার পর পরের দিন নারায়ণগঞ্জে শান্তির সমাবেশে ডাক দেয় আওয়ামী লীগ। একই দিন নারায়ণগঞ্জে জনসভার ঘোষণা দিলেও পরে পিছিয়ে আসেন শামীম ওসমান।
৩৫ জুলাই, রোববার (৪ আগষ্ট)
সকাল থেকেই আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠে নারায়ণগঞ্জ। নারায়ণগঞ্জের প্রায় সকল অলিগলি দখলে নিয়ে নেয় ছাত্র জনতা ও বিএনপি। রাস্তায় ছাত্র জনতার ধাওয়ায় পালিয়ে যায় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। নারায়ণগঞ্জে ওসমান পরিবারের আতংকের প্রতীক রাইফেল ক্লাবে হামলা ভাংচুর চালায় বিক্ষুব্ধ জনতা।
একই সময়ে নারায়ণগঞ্জের আদালতপাড়ায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাথে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে ঢাকা নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড বন্ধ হয়ে যায়। একই সময়ে ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়ক দখলে নিয়ে নেয় বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠন এবং ছাত্র জনতা। নারায়ণগঞ্জ জেলা জুড়ে তীব্র সংঘর্ষ চলতে থাকে। সংঘর্ষের এক পর্যায়ে নারায়ণগঞ্জ সদর থানাসহ বিভিন্ন থানা ও সরকারি স্থাপনায় হামলা চালানো হয়।
৩৬ জুলাই, সোমবার (৫ আগষ্ট)
সকাল থেকে নারায়ণগঞ্জ শহরে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। আন্দোলনকারীদের ঠেকাতে শহরের চাষাঢ়া ও আশেপাশের এলাকায় অবস্থান নেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। রুপায়ন টাওয়ারে অয়ন ওসমানের কার্যালয়ে সকাল থেকেই জড়ো হতে দেখা গেছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের।
সকাল দশটার দিকে ঢাকার অভিমুখে লংমার্চে যোগ দিতে জড়ে হতে থাকেন বিএনপি নেতাকর্মীরা ও ছাত্র-জনতা। মিশনপাড়াম চাষাঢ়া, ঢাকা নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড, ঢাকা নারায়ণগঞ্জ পুরাতন সংযোগ সড়কসহ বিভিন্ন দিক থেকে জড়ো হওয়া ছাত্র-জনতার সাথে এক পর্যায়ে চাষাঢ়া এলাকায় পুলিশের সংঘর্ষ বাধে। এসময় চাষাঢ়া গোল চত্বর এলাকা থেকে তিন দিকে জড়ো হওয়া ছাত্র-জনতার উপর গুলিবর্ষণ করতে থাকে পুলিশ ও ছাত্রলীগ।
সকাল এগারোটার দিকে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা শিক্ষার্থীদের উপর হামলা চালায়। এসময় সংঘর্ষে চাষাঢ়া এলাকা রণক্ষেত্রে পরিনত হয়। গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান যুবদল নেতা স্বজন।
এদিকে দুপুর বারোটার পর থেকে দৃশ্যপট পাল্টে যেতে শুরু করে। দুপুরের আগেই চাষাঢ়া ত্যাগ করে পুলিশ। এক পর্যায়ে ছাত্র জনতার প্রতিরোধের মুখে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরাও পালাতে বাধ্য হয়। দুপুরে সেনাপ্রধানের জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণের খবর পাওয়ার পর শহরের আশেপাশের এলাকা থেকে চাষাঢ়ার দিকে ছাত্র-জনতার ঢল আসতে শুরু করে।
দুপুর আড়াইটার দিকে খবর ছড়িয়ে পড়ে শেখ হাসিনা পালিয়েছেন। এই সময় পর্যন্ত চষাঢ়ার আশেপাশের এলাকায় অবস্থান করছিলেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। তবে সকার পতানের খবর পাওয়ার পর সকলে শহর ত্যাগ করতে থাকেন।
এদিকে সরকারের পতনের খবর পাওয়ার পর আনুষ্ঠানিক ঘোষণার আগেই চাষাঢ়া এলাকা জনসমুদ্রে পরিনত হয়। এসময় জাতীয় পতাকা হাতে বিজয় উল্লাস করতে দেখা গেছে। শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি প্রায় সকল শ্রেনী পেশার মানুষ এদিন রাজপথে নেমে আসে এই বিজয়ের সাক্ষী হতে। রাত পর্যন্ত মানুষের উল্লাস ও আনন্দ মিছিলে মুখরিত থাকে নারায়ণগঞ্জ। স্বাধীনতার পর এমন বিজয় উল্লাস দেখেনি নারায়ণগঞ্জ।
এরই মাঝে আওয়ামীলীগের ঘাটি খ্যাত রাইফেলস ক্লাবে অগ্নিসংযোগ, শামীম ওসমানদের বাড়িতে ভাংচুর করে বিক্ষুব্ধরা।