শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪

|

বৈশাখ ১২ ১৪৩১

Advertisement
Narayanganj Post :: নারায়ণগঞ্জ পোস্ট

দুর্ভেদ্য অপরাধ সাম্রাজ্য রূপগঞ্জের চনপাড়া

যুগান্তর

প্রকাশিত: ০৮:২২, ১ অক্টোবর ২০২২

দুর্ভেদ্য অপরাধ সাম্রাজ্য রূপগঞ্জের চনপাড়া

সংগৃহীত

এ যেন দুর্ভেদ্য এক অপরাধ সাম্রাজ্য। কি নেই এখানে! যে কোনো ধরনের মাদক পাওয়া যায় এখানকার অলিগলিতে। আছে ইয়াবা তৈরির কারখানা। অহরহ হয় দেশি-বিদেশি অস্ত্রের বেচাকেনা, দেহ ব্যবসা আর দাগী আসামিদের নিশ্চিন্তে পালিয়ে থাকার ‘সেফ হোম’।

সব শুনে কোনো তামিল সিনেমার কাহিনী মনে হলেও এর সবই বাস্তব। রূপগঞ্জের কায়েতপাড়া ইউনিয়নের চনপাড়া বস্তি বা চনপাড়া পুনর্বাসন কেন্দ্র এমনই এক দুর্ভেদ্য অপরাধ সাম্রাজ্যের নাম। প্রতি মাসে কোটি টাকার উপরে মাদক ও অস্ত্র ব্যবসার এই চনপাড়া বস্তি নিয়ে যুগান্তরের সরেজমিন প্রতিবেদনে মিলেছে নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য। 

আধিপত্য বিস্তার নিয়ে গত ২০ বছরে চনপাড়া বস্তিতে খুন হয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তাসহ প্রায় ১৫ জন। গত দেড় যুগে শুধু চনপাড়া এলাকার মাদক ব্যবসা সংক্রান্ত ঘটনায় রূপগঞ্জ থানায় দায়ের হওয়া মামলার সংখ্যা ২ হাজারের উপরে। সর্বশেষ গত ২৭ সেপ্টেম্বর রাতে এই আন্ডারওয়ার্ল্ডের সন্ত্রাসীদের সঙ্গে বন্দুক যুদ্ধের ঘটনা ঘটেছে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর।

মূল ব্যবসাই মাদকের

যুগান্তরের কয়েক দিনের তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, চনপাড়া পুনর্বাসন কেন্দ্রে মাদকের স্পট রয়েছে শতাধিক। এখানে মাদকের ব্যবসা হয় কয়েকটি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে। ফেনসিডিল, ইয়াবা, হেরোইন, মদ, গাজা বিক্রির জন্য রয়েছে পৃথক পৃথক সিন্ডিকেট। কেউ কারো সেক্টরে ব্যবসা করবে না কিংবা কারো এলাকায় কেউ প্রবেশ করবে না, এটাই এখানকার অলিখিত নিয়ম। আর নিয়ম ভাঙলেই আধিপত্য বিস্তার নিয়ে সংঘর্ষ, খুন কিংবা এক গ্রুপের সোর্স অন্য গ্রুপের মাদকের চালান সম্পর্কে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে তথ্য দিয়ে ধরিয়ে দেয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এখানকার বেশ কয়েকটি সূত্র জানিয়েছেন, মূলত সিন্ডিকেটের কেউ না কেউ বড় কোনো রাজনৈতিক শেল্টারেই এখানকার রাজত্ব করে। বছর কয়েক আগে এক প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার শেল্টারে থাকা এক সন্ত্রাসীকে অস্ত্রসহ গ্রেফতারের পরেও ‘উপরের মহল’ থেকে বেশ চাপ প্রয়োগ করা হয়েছিল এক কর্মকর্তাকে।

ওই সূত্র জানান, রাজনৈতিক সভা, মিছিলে লোক সাপ্লাই করা, মধ্যম থেকে নিম্ন সারির রাজনৈতিক নেতাদের ভাগবাটোয়ারা পৌঁছে দেওয়ার কাজটি করে সিন্ডিকেট।

ভৌগলিক কারণে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর শত চেষ্টার পরেও চনপাড়ার কর্তৃত্ব নেয়া সম্ভব হয়ে উঠে না। কারণ, চনপাড়া বস্তিতে প্রবেশের একটি মাত্র পথ থাকলেও এর ৩দিকে রয়েছে নদীপথ। ফলে সহজেই মাদক আনা নেওয়া এবং পুলিশের চোখ ফাঁকি দেয়া সম্ভব।

জানা গেছে, মূলত চনপাড়ায় মাদক বিক্রি হয় কয়েকটি স্তরে। প্রতিটি সিন্ডিকেটের একটি বা দুটি করে ওয়াচ পার্টি থাকে। এদের কাজ পোশাকে বা সাদা পোশাকের পুলিশ-র‌্যাব দেখলে সতর্ক করে দেয়া। এক গ্রুপ শুধু মাত্র খুচরা বিক্রি করে থাকে, যারা এক স্থানে বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। আর বড় ধরনের পাইকারি চালান নিয়ন্ত্রণ করে খোদ সিন্ডিকেটের প্রধানরা।

ওই সূত্রের দেয়া তথ্য মতে, কোনো কোনো সিন্ডিকেটের কয়েকশ নারী সদস্য রয়েছে যারা সরাসরি টেকনাফ থেকে কনডমের মধ্যে ইয়াবার চালান গোপনাঙ্গে করে নিয়ে আসে চনপাড়ায়। কখনো মাদক ব্যবসায় ব্যবহার করা হচ্ছে বেদে বহর, কখনো লবণবাহী সাম্পান আবার সিমেন্টের ক্লিংকারবাহী কার্গো জাহাজ।

কয়েক জন মাদককারবারিদের (পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে) ভাষায়, চনপাড়ার ইয়াবা ব্যবসায় ‘যুগান্তকারী বিপ্লব’ ঘটিয়েছেন এলাকার সবচেয়ে বড় ইয়াবার ডিলার স্বপন। প্রায় ১০ বছর আগে মিয়ানমার থেকে স্বপন ইয়াবা তৈরির ডাইস (মেশিন) কিনে এনে এখানেই ইয়াবার কারখানা স্থাপন করেছে। স্বপনের দেখাদেখি অপর ২টি সিন্ডিকেটও এখানে ইয়াবা তৈরি করছে বলে জানা গেছে।

সরেজমিন ঘুরে জানা গেছে, চনপাড়ার ২নং ওয়ার্ডের মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ করে প্রধান মোস্তফা ওরফে ডাকাত মোস্তফার সিন্ডিকেট। মাদক কারবার ছাড়াও অত্যাধুনিক অস্ত্র বেচাকেনাও এই সিন্ডিকেটের অন্যতম ব্যবসা।

এছাড়াও চনপাড়ার অস্ত্র ব্যবসার প্রধান সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করেন বজলু মেম্বার ওরফে ডন বজলু। এখানকার মাদক ব্যবসায়ীদের মধ্যে রয়েছে ১নং ওয়ার্ডের হোমা, মনির, বিলকিস, চিকা মনিরের ভাই পিচ্চি আনোয়ার, আসলাম, নুর হোসেন, স্বপনের সেলসম্যান রাসেল, আয়নাল, জনি ও হাসি।

২নং ওয়ার্ডে জুয়েল, মোহাম্মদ আলী, কয়লারানী, ফারুক, শামীম ও শিল্পী। ৩নং ওয়ার্ডের মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ করে সাহাবুদ্দিন ওরফে সাবুর সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটের কালাম, আবুল, বাবুল, আরিফ ও শহিদুল মাদকের কারবার দেখাশোনা করছে। ৪নং ওয়ার্ডের মুজাহিদ, নুর জামাল, জনি, কদবানু ও শামসুন্নাহার করছেন ইয়াবা ও হেরোইনের ব্যবসা।

৫নং ওয়ার্ডের মিল্লাত, ৬নং ওয়ার্ডের মাদকের প্রধান ডিলার বজলু মেম্বারের ছোট ভাই মীজান ওরফে বোতল মিজু, সেলিম, কামাল সামলাচ্ছেন মাদক ব্যবসা। ৭নং ওয়ার্ডের আলম, চানপুইরা লিটন, ৮নং ওয়ার্ডের জাহাঙ্গীর, রাজিব, মোকলেছ এবং ৯নং ওয়ার্ডের শাহ আলম, রোশনী, ল্যাংড়া শাহিন, শামীম, অপু ও মাইগ্যা রাজু বর্তমানে সক্রিয়ভাবে মাদক ব্যবসা করছেন।

এর মধ্যে গত ২৯ সেপ্টেম্বর র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হওয়া মাদক সম্রাট রাজু ওরফে রাজা চনপাড়া পুনর্বাসন কেন্দ্র এলাকার মাদক নির্মূল কমিটির আহবায়ক ছিলেন বলে জানা গেছে।

আধিপত্য ধরে রাখতে খুন

২০০৩ সাল থেকে চনপাড়া এলাকায় মাদক ব্যবসার আধিপত্য আর এতে বাধা দেয়ার কারণে এক ডজনের বেশি খুনের ঘটনা ঘটেছে। ২০০৩ সালে এখানে খুন হন ফিরোজ সরকার, ২০০৪ সালে ফারুক মিয়া। ২০০৫ সালে খুন হন পুলিশের এএসআই হানিফ মিয়া ও ক্রিকেটার ফালান মিয়া। ২০০৮ সালে খুন হন আব্দুর রহমান, ২০১১ সালে হত্যার শিকার হয় র‌্যাবের সোর্স খোরশেদ মিয়া। ২০১৬ সালের ১২ মার্চ প্রজন্ম লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মনির হোসেনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে হত্যার শিকার হয় আসলাম হোসেন নামে এক স্কুলছাত্র, ওই বছরের ২৯ নভেম্বর থানা জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক হাসান মুহুরিকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ২০১৯ সালের জুন মাসে নিহত হাসান মুহুরির স্ত্রী ও সংরক্ষিত মহিলা ইউপি সদস্য বিউটি আক্তার কুট্টিকেও হত্যা করা হয়। চলতি বছরের ১৭ জুন ২ গ্রুপের আধিপত্য বিস্তারে টানা ২ দিনের সংঘর্ষে খুন হন সজল মিয়া নামের এক যুবক ও গুলিবিদ্ধ হন ১০ জন।

এ ব্যাপারে নারায়ণগঞ্জ জেলার পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা রাসেল জানান, আমি ২ মাস হলো এই জেলায় এসেছি। যতটুকু জানতে পেরেছি, চনপাড়া বস্তির সাধারণ বাসিন্দারা সন্ত্রাসীদের ভয়ে মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কোনো প্রকারের তথ্য বা আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে সাহায্য করতে পারেন না। তাছাড়া ভৌগলিক কারণে চনপাড়া বস্তিতে ব্লক রেইড দেয়া খুবই দু:সাধ্য।

তিনি বলেন, অভিযানে গেলেও বস্তির অসংখ্য সংকীর্ণ গলির কারণে বেগ পেতে হয়, বস্তির ৩ দিকে নদীপথ থাকায় তারা পালিয়ে যেতে সক্ষম হয় বিভিন্ন সময়ে। কিন্তু আইন শৃঙ্খলা বাহিনী চনপাড়াকে পুরোপুরি মাদক বা অপরাধমুক্ত করতে পারবে না একথা মানতে নারাজ আমি। খুব শিগগিরই চনপাড়ার মাদক ব্যবসাসহ নানা অপরাধের মূল উৎপাটন করা হবে এবং এজন্য যৌথ অভিযান পরিচালনা করবো আমরা।

তবে চনপাড়ার সাধারণ বাসিন্দারা আক্ষেপ করে জানান, সেনাবাহিনীর অভিযান ছাড়া চনপাড়ার মাদক ব্যবসা কিংবা অপরাধ সাম্রাজ্য ধ্বংস করা মনে হয় অসম্ভব বিষয়। কারণ গত ২ দশকে পুনর্বাসন কেন্দ্রটি পরিণত হয়েছে অপরাধের রাজ্য হিসেবে। এখানে মাদক ব্যবসা, অস্ত্র ব্যবসা, ডাকাতি, ছিনতাই, অপহরণ, দেহ ব্যবসার মতো অপরাধের সঙ্গে যুক্ত বিশাল সিন্ডিকেটের কারণে আমরা অসহায়। শুধুমাত্র আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষে এই অপরাধ নির্মূল করা সম্ভব হবে না যদি স্থানীয় সব রাজনৈতিক নেতা জনপ্রতিনিধিরা এক না হন।