
জান্নাতুল ফেরদৌস জিসান
সাংবাদিক সৌরভ হোসাইন সিয়ামের ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে নেয়া: “গায়েবি” মামলার সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার। তাদের ফ্যাসিবাদী শাসন জিইয়ে রাখতে বিরুদ্ধমত দমনে নিরপরাধ বহু মানুষকে হয়রানি করেছে এসব “গায়েবি” মামলায়। দেখা যেতো, ঘটনাও ঘটেনি এমনও বহু ঘটনায় বিদেশে থাকা, এমনকি মৃত ব্যক্তিও হতেন আসামি। এসব মামলায় বাদী হিসেবে ব্যবহার করা হতো রাষ্ট্রীয় অঙ্গগুলোকে, বিশেষত পুলিশ। পুলিশকেও দেখেছি উৎসাহ নিয়ে মামলাগুলো করতো, চলতো ব্যাপক গ্রেপ্তার-বাণিজ্য।
গণঅভ্যুত্থানের মুখে স্বৈরাচারী সরকার পতনের পর অন্তত রাষ্ট্রীয় এ হয়রানি থেকে মুক্তি মিলবে বলে আশা করেছিল জনসাধারণ। কিন্তু আগস্টের পর বাংলাদেশে প্রথম “গায়েবি” মামলাটি দায়ের হয় নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায়। এ মামলাটিরও বাদী এ থানার সাব-ইন্সপেক্টর রিপন মৃধা। গত ১২ মে মামলাটি রেকর্ড হয়।
সাবেক সিটি মেয়র আইভীকে গ্রেপ্তারের সময় পুলিশের উপর হামলার অভিযোগে মামলাটি দায়ের করা হয়। অথচ ওইদিন কারা আইভী সমর্থক ও আইভীকে বহন করা পুলিশের গাড়ি লক্ষ্য করে ঢিল ছুড়েছিল এবং হাতবোমা (ককটেল) ফুটিয়েছিল তা প্রত্যক্ষ করেছেন ঘটনার সময় উপস্থিত অসংখ্য মানুষ। উপস্থিত সাংবাদিকদের ধারণ করা ভিডিওতে হামলাকারীরা চিহ্নিতও হয়েছেন। হামলাকারীদের মধ্যে যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের পদধারী নেতারাও ছিলেন। অথচ পুলিশ ঘটনার তিনদিন পর মামলায় এমন মানুষকে আসামি করলেন যারা ঘটনার সময় ছিলেন না, এমনকি মামলায় এমন এক নারীকে আসামি করা হয়েছিল যিনি ছিলেন অন্তঃসত্ত্বা।
মামলার বর্ণনা অনুযায়ী, এ অন্তঃসত্ত্বা নারী রাতভর জেগে থেকে আইভীকে গ্রেপ্তারে পুলিশকে বাধা দিছেন এবং সকালে সুযোগ বুঝে আবার আইভীকে বহন করা পুলিশের গাড়িতেও ঢিল মেরেছেন।
যে রাতে মামলাটি রেকর্ড হয় সে রাতেই তড়িৎকর্মা পুলিশ একটি পরিবারের তিনজন সদস্যকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে আসে। তাদের মধ্যে একজন জুলাইযোদ্ধা জান্নাতুল ফেরদৌস জিসান। সদ্য এইচএসসি পাশ করা ছেলেটি জুলাই আন্দোলনে এই পুলিশ ও আওয়ামী সন্ত্রাসী বাহিনীর গুলির সামনে দাঁড়িছিল কেবল একটি ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা পাবে সেই আশায়। আন্দোলনের সময় পায়ের লিগামেন্টে চোট পাওয়া ছেলেটি এখনও ব্যথায় কাতরায়।
জিসান জুলাই আন্দোলনে যে আকাঙ্খা নিয়ে রাজপথে নেমে এসেছিল, সেই আকাঙ্খা নিয়েই আন্দোলন-পরবর্তী সময়ে যুক্ত হয়েছিল সাংবাদিকতায়। প্রেস নারায়ণগঞ্জে কাজ করছিল রিপোর্টার হিসেবে। পুরোটা সময় আমার সঙ্গেই কাজ করেছে ছেলেটি। প্রতিভাবান এ ছেলেটি প্রথম আলোর কিশোর ম্যাগাজিন “কিশোর আলো”তেও কন্ট্রিবিউটর হিসেবে লিখতো। প্রথম আলো বন্ধুসভার পরিবেশ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদকও জিসান।
ওকে গ্রেপ্তারের পর সরাসরি পুলিশকে চ্যালেঞ্জ করেছিলাম, বলেছিলাম, ন্যূনতম তথ্য-প্রমাণ ছাড়াই আপনারা ছেলেটিকে মামলায় আসামি করেছেন এবং তাকে ও তার পরিবারের সদস্যদের তড়িঘড়ি করে গ্রেপ্তারও করেছেন রাজনৈতিক প্ররোচনায়।
যদিও তখন পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্তা দাবি করেছিলেন, ঘটনার দিনের ভিডিও, ছবি ও ইনটেলিজেন্স তথ্য যাচাই করেই এ কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন তারা। কিন্তু ন্যূনতম একটা ভিডিও/ছবি তখন দেখাতে পারেনি পুলিশ। এমনকি গণমাধ্যমে প্রকাশিত ভিডিও-ছবিতে যাদের হামলা করতে দেখা যাচ্ছিলো তাদের কেউই আসামি হননি, কেননা তারা বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। অথচ, আগস্টের আগেও দেখেছি, নিজেরা ঘটনা ঘটিয়ে কিংবা ঘটেওনি এমন সব ঘটনা বানিয়ে বিএনপির লোকজনের নামে মামলা দিতো আওয়ামী লীগ। ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর কেবল নামগুলো বদলে গেছে এই আরকি।
এ মিথ্যা ও গায়েবি মামলায় আজ ৭৩ দিন জেল খাটার পর উচ্চ আদালতের আদেশে জামিনে বের হচ্ছে জিসান। ওর অপেক্ষায় জেলা কারাগারের সামনে পরিবার ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা।
এর আগে নিম্ন আদালতে তিনবার জামিন আবেদন করার পরও জামিন নাকচ করে দেওয়া হয়। পরে জেনেছি, জামিন যাতে না হয় সেই চেষ্টায় নিজেদের বিলিয়ে দিয়েছিলেন কয়েকজন বিএনপি ও জামায়াতের নেতা। কারণ, মামলাটি আওয়ামী লীগ নেত্রী আইভীর ঘটনা-সংশ্লিষ্ট। অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে, এক বিএনপিন্থী আইনজীবী মামলাটি লড়তে সম্মতি জানালেও এজলাসে দাঁড়াতে পারেননি। কারণ, সিনিয়র নেতারা নিষেধ করেছেন। আর বেঞ্চ আর বারের মধ্যকার “অলিখিত বোঝাপড়া” সম্পর্কে যারা জানেন তাদের জানিয়ে রাখি, জেলা আইনজীবী সমিতির নেতৃত্বও এখন বিএনপিপন্থীদের কাছে। নির্বাচন-নির্বাচন গান গাওয়া বিএনপির ৫ আগস্টের পর আইনজীবী সমিতির নেতৃত্ব বদলাতে ভোটেরও প্রয়োজন হয়নি।
শুধুই কি তাই, জুলাই আন্দোলনে সক্রিয় জিসানের পাশে দাঁড়ায়নি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নামে প্ল্যাটফর্মটিও। ন্যূনতম বিবৃতি পর্যন্ত না। যে এনসিপি জুলাই-জুলাই করে মুখে ফ্যানা তুলে ফেলে, তারাও না। কেননা, জিসান বৈষম্যবিরোধী কমিটিতে নেই। জিসানরা কমিটিতে থাকে না, কারণ জুলাই-এর পর তারা বাটোয়ারার হিসেবে যেতে চায়নি। জিসানদের পাশে কেউ দাঁড়ায় না, কারণ সে সবসময় নির্যাতকের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর বাসনা রাখে, সেই নির্যাতক হোক আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি কিংবা যে কেউ। জিসানরা দলদাস হইতে পারে না, পারে না বলেই জুলাই হয়েছে।
অবশেষে গত সোমবার উচ্চ আদালত জিসান ও তার বাবার জামিন মঞ্জুর হয়। “জামিন মঞ্জুর” এই শব্দটি শোনার জন্য গত ৭৩ দিন যে কী পরিমাণ মানসিক-শারীরিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে গিয়েছি, তার হিসেব দিতে পারবো না। কেবল জানতে চাই, জিসানরা এই বন্দোবস্তের জন্যই কি গুলির মুখে সিনা টান করে দাঁড়িয়েছিল?
জিসানকে যেদিন প্রিজন ভ্যানে কারাগারের দিকে নেওয়া হয়, সেদিন চিৎকার করে বলেছিল, “আন্দোলন করে, লড়াই করে যে বিএনপিকে বাড়িতে থাকার সুযোগ করে দিলাম, সেই বিএনপিই আমারে জেলে ভরলো!”
এই হচ্ছে, নয়া বন্দোবস্ত। যেই নয়া বন্দোবস্তে জুলাই-যোদ্ধা জিসানরা জেলে রাত কাটায় আর ছাত্র-জনতা-শ্রমিকের জীবনের বিনিময়ে পাওয়া “নতুন বাংলাদেশ”-এর দখল নিতে মরিয়া সুবিধাবাদীরা।
কিন্ত, ভুলে গেলে চলবে না, “উপরওয়ালা সবকিছুর হিসাব রাখেন, এই ৭৩ দিনের হিসাবও...”