
ফাইল ছবি
নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে একের পর এক গণপিটুনির ঘটনায় উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। গত ৯ মাসে কমপক্ষে ২০টি গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় নিহত হয়েছেন পাঁচজন। কয়েকটি ক্ষেত্রে মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে লোক জড়ো করে নৃশংসতা চালানো হয়। মব সৃষ্টি করে পিটুনি দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করারও ঘটনা ঘটেছে।
আড়াইহাজার থানার পুলিশ জানিয়েছে, প্রতিটি ক্ষেত্রে অসংখ্য অজ্ঞাত আসামি দেখিয়ে মামলা হয়েছে। কোনো ঘটনায় নিহতের পরিবার এবং কোনো ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করে। সবগুলোরই তদন্ত চলছে। তবে গত ৯ মাসের কোনো ঘটনাতেই কাউকে গ্রেপ্তার বা আটক করা হয়নি।
স্থানীয় সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের ভাষ্যমতে, এ ধরনের সহিংসতা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের দুর্বলতা এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে এটি ক্রমেই ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঘটনার সময় সঙেগ্ সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিত না হওয়া বা উপস্থিত হলেও মবের ভয়ে ঠেকাতে না পারা এবং পরে কাউকে গ্রেপ্তার না করায় গণপিটুনির মতো নৃশংস ঘটনা ঘটাতে মানুষ দ্বিধা করছে না।
সর্বশেষ গত ৩০ সেপ্টেম্বর রাত ৩টার দিকে ডাকাত সন্দেহে বিশনন্দী এলাকায় নবী হোসেন (২৮) নামে এক যুবককে গণপিটুনিতে হত্যা করা হয়। স্থানীয়দের তথ্যমতে, ১৮-২০ জনের একটি ডাকাত দল ওই দিন রাত আড়াইটার দিকের পর্যায়ক্রমে কয়েকটি বাড়িতে ডাকাতি শেষে ইলিয়াছ মিয়ার হানা দেয়। এরই মধ্যে বিশনন্দী এলাকার তিন বাড়িতে ডাকাতির ঘটনার খবর মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিলে বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী লাঠিসোটা নিয়ে ডাকাত দলকে ধাওয়া দিয়ে নবী হোসেনকে আটক করে ফেলে। তাদের পিটুনিতে নিহত হন তিনি। নবী হোসেন উচিতপুরা এলাকার রূপ মিয়ার ছেলে। তাঁর বিরুদ্ধে থানায় কোনো মামলা নেই বলে পুলিশ জানায়।
এর এক দিন আগে চাঁদা দাবির অভিযোগ এনে বালিয়াপাড়া এলাকায় বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী পুরস্কারঘোষিত মাদক কারবারি সোহেল মিয়া ওরফে ফেন্সী সোহেলের (৩৫) হাত-পা বেঁধে পিটিয়ে হত্যা করে। তিনি ব্রাহ্মন্দী ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য ছিলেন। এক্ষেত্রেও মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে লোক জড়ো করা হয়।
সোহেলের বিরুদ্ধে আড়াইহাজার থানাসহ বিভিন্ন থানায় হত্যা, মারামারি, অগ্নিসংযোগ, মাদকসহ ১৩টি মামলা রয়েছে। মামলার বিষয়টি স্বীকার করলেও সোহেলের স্ত্রী সুমাইয়া ইসলাম বাবলী বলেন, পরিকল্পিনা করে তাঁর স্বামীকে হত্যা করা হয়েছে। ওই দিন সকাল ৮টা থেকে প্রায় ৩ ঘণ্টা সোহেলকে বেঁধে পেটানো হয়েছে। অথচ এই সময়ের মধ্যে পুলিশ যায়নি। এ ঘটনায় গত বুধবার বাবলী ২০০-২৫০ জনকে অজ্ঞাত আসামি করে মামলা করেন।
৮ সেপ্টেম্বর প্রভাকরদী এলাকার রাস্তায় ছিনতাই করার অভিযোগে গণপিটুনিতে আয়নাল হোসেন (৪২) নামের এক ব্যক্তিকে নিহত হন। তাঁর বিরুদ্ধে একাধিক ডাকাতির মামলা রয়েছে।
গত ৪ জানুয়ারি জোগারদিয়া এলাকায় ডাকাতির চেষ্টার অভিযোগে মকবুল হোসেন মুকুলকে (৪৫) পিটুনি দিয়ে হত্যা করে বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী। এক্ষেত্রেও মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে লোক জড়ো করা হয়। পুলিশ জানায়, মুকুলের বিরুদ্ধে আড়াইহাজারসহ বিভিন্ন থানায় খুন ডাকাতিসহ বেশ কিছু মামলা রয়েছে।
গত ২৭ ডিসেম্বর রাতে ডাকাতির চেষ্টার অভিযোগে কাহিন্দী এলাকায় বিল্লাল হোসেনকে (৪৫) গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়। আহত করা হয় লাভলী আক্তার নামে এক নারীকে। জানা যায়, স্থানীয় মসজিদের মাইকে ডাকাত পড়ার ঘোষণা দিলে আশপাশের গ্রামের ৭০০-৮০০ লোক একত্র হয়ে ধাওয়া দিয়ে বিল্লালকে আটক করে। পরে কাহেন্দী ব্রিজের দক্ষিণ পাশে ওয়াসার লাইনের কাছাকাছি নিয়ে পিটুনি দিলে তাঁর মৃত্যু হয়। বিল্লালের বিরুদ্ধে আড়াইহাজারসহ বিভিন্ন থানায় খুন ডাকাতিসহ অন্তত আটটি মামলা রয়েছে।
২২ আগস্ট কালাপাহাড়িয়া ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি আবু কালামকে মব সৃষ্টি করে পিটুনি দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করা হয়। ২ আগস্ট উপজেলা সদরে দোকানে চুরির অভিযোগে মিজান মিয়া ও সিরাজুল ইসলাম নামে দুই তরুণকে আটক করে পিটুনি দেন বিক্ষুব্ধ দোকানদাররা।
১ এপ্রিল সাতগ্রাম ইউনিয়নের চারিগাঁও এলাকায় আওলাদ হোসেন কাজল (৩২) নামে এক ব্যক্তিকে পিটিয়ে পুলিশে দেয় স্থানীয় একটি চক্র। তিনি সাতগ্রাম ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। ১৫ মার্চ বাড়ি থেকে ডেকে এনে সাতগ্রাম ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জুয়েল প্রধানকে পিটিয়ে আহত করে পুলিশে সোপর্দ করা হয়।
২৩ জানুয়ারি রাতে চাঁদাবাজি ও মাদক কারবারের অভিযোগে উপজেলার ফাউসা এলাকাবাসী ব্রাহ্মন্দী ইউনিয়ন ৭ নম্বর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাসুদ রানা ও ইমরান হোসেন নামে এক পুলিশ কনস্টেবলকে আটক করে মারধর করে পুলিশে সোপর্দ করেছে।
গণপিটুনি আইনের দৃষ্টিতে ‘হত্যা’ এবং এর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা হত্যাকারী হিসেবেই চিহ্নিত হন, এমনটাই মত দেন সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবি কাজী আব্দুস সেলিম। তাঁর মতে, আড়াইহাজারে ডাকাতি ও মাদক নির্মূলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যকর ভূমিকা না থাকায় সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ। এ ছাড়া দীর্ঘদিনের অগণতান্ত্রিক পরিবেশ, গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা, প্রশাসনে অস্থিতিশীলতা ও ভীতি এবং আমলাতন্ত্রকে পরিচালনায় অদক্ষতাই গণপিটুনি বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ।
গণপিটুনিসহ আইনশৃঙ্খলার অবনতির মতো ঘটনার সংবাদ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয় বলে দাবি করেন আড়াইহাজার থানার ওসি খন্দকার নাসির উদ্দিন। তিনি বলেন, দেশের প্রচলিত আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা ও বিচার প্রক্রিয়াকে পাশ কাটিয়ে নিজের হাতে আইন তুলে নেওয়া কখনোই সমাধান হতে পারে না। এতে সমাজে অরাজকতা সৃষ্টি হয় এবং নিরপরাধ কেউ অন্যায়ের শিকার হতে পারেন। অপরাধ করলে শাস্তি দেওয়ার অধিকার শুধু রাষ্ট্র ও আদালতের। জনগণের কাজ হচ্ছে অপরাধীকে আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া। তিনি আরও বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন জায়গায় ছোটখাটো ঘটনার জেরে মানুষকে মারধর বা গণপিটুনির মতো পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এতে বিচার প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে এবং অপরাধ প্রমাণের আগেই শাস্তি হয়ে যাচ্ছে, যা মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল।