
ফাইল ছবি
নারায়ণগঞ্জে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের মধ্যে ‘যুবদল কর্মী’ শাওন প্রধান নিহতের ঘটনায় তার ভাই হত্যা মামলা করেছেন বলে পুলিশ জানালেও পরিবারের অন্য সদস্যরা বলছেন, এ বিষয়ে ‘কিছুই জানেন না’ তারা।
বৃহস্পতিবার দুপুরে শাওন নিহত হওয়ার পর রাতে তার বড় ভাই মিলন হোসেন বিএনপির অজ্ঞাতপরিচয় ৫ হাজার জনকে আসামি করে ওই মামলা করেন বলে পুলিশের ভাষ্য।
শুক্রবার নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার গোপালনগরে শাওনদের বাড়ি গিয়ে মিলনকে পাওয়া যায়নি, ফোনেও পাওয়া যায়নি।
তাদের ছোট ভাই ফরহাদ প্রধান বলেন, “আমি মামলার বিষয়ে কিছুই জানি না। গুলি খাইছে শুইনা হাসপাতালে গেছি৷ হাসপাতাল থেইকা লাশ দিছে রাত্রের সাড়ে ১২টা বাজে৷ দেড়টা বাজে জানাজা হইছে৷ রাত্রে ২টা বাজে মাটি দিয়া বাসায় আইছি৷ কই থেইক্কা মামলা করলাম, কই গেলাম এগুলা তো আমি নিজেই কইতে পারতেছি না।”
“থানায় আমি যাই নাই৷ হাসপাতালে কয়েকজন আসছিল, হেরা কয়েকজনের সাক্ষ্য নাকি নিয়া গেছে৷”
শাওনের মা ফরিদা বেগম বলেন, “মামলার কোনো কিছু আমি জানি না। মিলনে মামলা করছে কি-না আমি কইতে পারি না।”
এ বিষয়ে রাতে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) আমীর খসরু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মামলাটি বৃহস্পতিবার রাতে রেকর্ড করা হয়েছে। পুলিশের সঙ্গে বিএনপির সংঘর্ষে বিএনপি নেতা-কর্মীদের ছোড়া ইট ও গুলির আঘাতে গুরুতর জখম হয়ে তার ভাই মারা গেছেন বলে বাদী উল্লেখ করেছেন।”
জোর করে মামলা করানোর অভিযোগ ‘সঠিক নয়’ দাবি করে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, “নিহতের ভাই মিলন প্রধান নিজে বাদী হয়ে স্বেচ্ছায় মামলাটি করেছেন।”
বৃহস্পতিবার বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে শহরের ডিআইটি রোডে দলটির নেতাকর্মীরা পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়। সে সময় নিহত হন ২০ বছর বয়সী শাওন।
বিকালে ময়নাতদন্তের পর রাতেই কড়া পুলিশ প্রহরায় দাফন করা হয় শাওনকে। তিনি সদর উপজেলার এনায়েতনগর ও বক্তাবলী ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী পূর্ব গোপালনগরের প্রয়াত সাহেব আলীর ছেলে।
পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, শাওন ‘রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত নন’। তার চাচা ফতুল্লা থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও বক্তাবলী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান শওকত আলীও বলেন, তার ভাতিজারা ‘সরাসরি কোনো দল’ করেন না।
কিন্তু বিএনপি নেতারা দাবি করেন, শাওন বক্তাবলী ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তার ফেইসবুক পেইজেও সংগঠনে সক্রিয় থাকার তথ্য ও ছবি পাওয়া যায়।
শুক্রবার দুপুরে শাওনের বাড়ি গিয়ে তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করে সহানুভূতি প্রকাশের সময় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তাকে ‘যুবদলের কর্মী’ বলেই উল্লেখ করেন। তিনি অভিযোগ করেন, শাওনের রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে পুলিশ ও প্রশাসন ‘মিথ্যাচার’ করছে।
সন্ধ্যায় শাওনদের বাড়িতে গিয়ে তার রাজনৈতিক পরিচয় জানতে চাইলে তার মা ফরিদা বেগম বলেন, “বিএনপি করতো কি-না জানি না৷ ছোট মানুষ, (মিছিল) দেখতেও যাইতে পারে৷ তিন পোলার কোনোটায়ই কোনো দলে নাই, কিছুত নাই৷ কেউ ডাক দিলে তাগো লগে যাইতে পারে৷
“আমার স্বামী নাই৷ পুতে গো নিয়া থাকি৷ এইটাতে (মিছিলে) কালকা কোন ইয়াতে নিছে আল্লায় জানে৷ ছ্যারারা ডাক দিছে তাগো লগে ঘুরতে গেছে বা দেখতে গেছে৷ গেলে গুলি-মুলিও খাইতে পারি, এমন তো ভাবে নাই৷”
শাওনের বড় ভাই মিলনের সাথে কথা বলতে শুক্রবার বিকাল ৪টার দিকে তাকে ফোন করলে ধরেন তার দুলাভাই (বড়বোনের স্বামী) ব্যবসায়ী মো. আফজাল। তিনি বলেন, মিলন অন্য ঘরে ‘বিশ্রাম নিচ্ছে’।
কিন্তু সন্ধ্যায় তাদের বাড়িতে গেলে পরিবারের সদস্যরা বলেন, বাসা থেকে বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে বেরিয়ে আর ফেরেননি মিলন।
শাওনের ছোট ভাই ফরহাদ সে সময় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ভাই বাসাতেই আছিল। মোবাইল নিয়ে বের হইয়া আর ঢুকে নাই। ফোন দেওয়ার পরও ধরতেছে না।”
ওই বাসায় বসেই সন্ধ্যায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের পক্ষ থেকে আবার ফোন করা হয় মিলনের নম্বরে। এ সময় ফোন বাজলেও তিনি ধরেননি।
ওই বাড়িতে কথা হয় শাওনের খালাতো ভাই জিহাদ হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার শাওনের গুলি লাগার খবর পেয়ে থানায় গিয়েছিলেন মিলন৷ লাশের সঙ্গে বাড়ি ফেরেন মধ্যরাতের পর।
“হাসপাতাল থেইকা লাশ নেওয়ার জন্য পুলিশ ক্লিয়ারেন্স লাগতো৷ সেই ক্লিয়ারেন্স আনতে মিলন ভাই দুপুর দেড়টার দিকে থানায় গেছে৷ তারে ওই সময় আর থানার থেইকা বের হইতে দেয় নাই৷”
শাওনের দুলাভাই মো. আফজাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রাত ১২টার পরে লাশ ছাড়ে হাসপাতাল থেকে৷ হাসপাতাল থেকে আনতে আনতে সাড়ে ১২টার বেশি বেজে যায়৷ জানাজা দেই দেড়টায়৷ তারপর কবরের কাজ শেষ করে বাসায় বিশ্রামেই ছিলাম৷ মিলনও সারাদিন বিশ্রামে ছিল৷”
তিনি বলেন, “মিলন নাকি রাত ২টার দিকে মামলা করছে- নিউজে এমনটা লিখছে৷ কিন্তু জানাজাই হইসে রাত দেড়টায়৷ তাহলে ২টায় কেমনে মামলা করে?”
শাওনদের বাড়িতে তার বোনের দেবর আব্দুল জলিলও জানান, রাত সাড়ে ১২টার পর বাড়িতে লাশ আসার পর তারা গোসল দিয়ে জানাজার আয়োজন করতে রাত ১টা ২০ বেজে যায়। দেড়টায় শাহ্ওয়ার আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে জানাজা হয়, দাফন হয় ২টার দিকে।
থানায় হওয়া মামলার বিষয়ে প্রশ্ন করলে শাওনের দুলাভাই আফজাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমার জানা মতে, আমাদের পক্ষ থেকে কোনো মামলা করা হয়নি। হয়ত লাশ আনার ব্যাপারে কোনো কাগজপত্রে স্বাক্ষর করতে পারে৷ কিন্তু কোনো মামলার ঝামেলায় যেতে চাই না৷
“আমরা চাই, সুষ্ঠু বিচার হোক। কিন্তু কার নামে মামলা করব আমরা? সুষ্ঠু বিচার চাই, কিন্তু আমরা কোনো মামলায় যেতে চাইতেছি না৷ মামলা করবও না৷ সুষ্ঠু সমাধান চাই৷”
পরিবারের বক্তব্যের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) আমীর খসরু রাতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, দাফনের পরে নয়, মামলা হয়েছে ‘রাত ৮টার দিকে’।
“বাদী মামলা করার পরে লাশ নিয়ে বাড়িতে চলে গেছে। সে তার ভাইকে হারিয়েছে, তাকে পুলিশি হেফাজতে নেওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। এটা অমানবিক। হয়ত এদিক-সেদিক কোথায়ও গেছেন। তাকে আমরা হেফাজতে নিইনি।”
এদিকে শাওনের মৃত্যু কীভাবে হয়েছে, তা নিয়েও অস্পষ্টতা তৈরি হয়েছে। বিএনপি দাবি করে আসছে, শাওনের মৃত্যু হয়েছে পুলিশের গুলিতে। ডাক্তারও বলেছিলেন, শাওনকে হাসপাতালে নেওয়া হয় গুলিবিদ্ধ অবস্থায়।
বৃহস্পতিবার বিকেলে নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে শাওনের মরদেহের ময়নাতদন্ত করেন মফিজ উদ্দিন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) শেখ ফরহাদ শুক্রবার দুপুরে বলেন, “নিহতের বুকের বা পাশে এবং পিঠের নিচের অংশে দুটি ক্ষত চিহ্ন পাওয়া গেছে। গভীর ক্ষত দুটি। তবে শরীরে কোনো গুলি পাওয়া যায়নি।”
“বুকের বা পাশে একটি এবং পিঠের নিচের অংশে আরেকটি ক্ষত চিহ্ন পাওয়া গেছে।”
কী কারণে শাওনের মৃত্যু হয়েছে জানতে চাইলে চিকিৎসক বলেন, “এই বিষয়ে ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পেলে পরে বিস্তারিত বলা যাবে।”বিষয়টি নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে শাওনের ছোটভাই ফরহাদ প্রধান বলেন, “তদন্ত কইরা দেখুক এইটা কীভাবে হইল, ক্যামনে আমার ভাই মারা গেল৷… আমার ভাই তো গুলি খাইয়াই মারা গেছে৷ বুকের বাম পাশে গুলি করছে৷ এখন কে গুলি করে সেইটা সুষ্ঠু তদন্ত করলেই পাওয়া যাইব।”
সুত্রঃ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম