ফাইল ছবি
শুক্রবারের শক্তিশালী ভূমিকম্প এবং শনিবারের পরপর দুই মৃদু কম্পনের পর শিল্পনগরী নারায়ণগঞ্জকে মাঝারি ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে বিশেষভাবে চিহ্নিত করেছেন ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা। ঢাকাকেন্দ্রিক কম্পনের ধারাবাহিকতা, নরম পলিভূমি, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, ঘনবসতি এবং বহুতল ভবন নির্মাণের প্রবণতা সব মিলিয়ে নারায়ণগঞ্জে ভূমিকম্প-পরবর্তী বিপদ বাড়ছে বলে মনে করছেন তারা। সাড়ে সাত ঘন্টার ব্যবধানে দুইবার ভূমিকম্পনে জেলার বিভিন্ন এলাকায় আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। পুরনো ভবনগুলোর দেয়ালে নতুন ফাটলেরও তথ্য পাওয়া গেছে।
শনিবার সকাল ১০টা ৩৬ মিনিটে একটি মৃদু কম্পন এবং সন্ধ্যা ৬টা ৪ মিনিটে আরেক দফা কম্পন অনুভূত হয়, যাদের মাত্রা ছিল যথাক্রমে ৩ দশমিক ৩ এবং ৩ দশমিক ৭। আবহাওয়া অধিদপ্তরের মতে, এগুলো শুক্রবার সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটে নরসিংদীর মাধবদীকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া ৫ দশমিক ৭ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্পের পরবর্তী আফটারশক। মূল কম্পনের তীব্রতায় নরসিংদী, গাজীপুর ও ঢাকার পাশাপাশি নারায়ণগঞ্জেও ক্ষয়ক্ষতির ঘটনা ঘটেছে।
রূপগঞ্জে একটি ঘরের দেয়াল ধসে পড়ে এক শিশুর মৃত্যু নিশ্চিত করেছে স্থানীয় প্রশাসন। শিশুটির মা গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। জেলার বিভিন্ন হাসপাতালে অন্তত ২৪ জন আহত হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। আতঙ্কে দৌড়াদৌড়ি, সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত নামতে গিয়ে পড়ে যাওয়া অথবা প্যানিক অ্যাটাক—এসব কারণেই বেশি মানুষ আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূমিকম্প ঝুঁকি বিচার করলে বাংলাদেশ তিনটি অঞ্চলে বিভক্ত। জোন–১ এলাকা যেমন সিলেট, টাঙ্গাইল, গাজীপুর, ময়মনসিংহ ও নরসিংদীর বেশিরভাগ অংশ উচ্চঝুঁকিতে, তেমনি জোন–২ হিসেবে চিহ্নিত ঢাকার সঙ্গে নারায়ণগঞ্জও মাঝারি ঝুঁকির এলাকায় রয়েছে। এই অঞ্চলে ঘনবসতি, শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ঘনত্ব, নির্মাণে অনিয়ম, নরম মাটি এবং ফল্ট লাইনের সান্নিধ্য—সব মিলিয়ে মাঝারি ঝুঁকি সহজেই বড় ঝুঁকিতে রূপ নিতে পারে।
নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা, সিদ্ধিরগঞ্জ, বন্দর, রূপগঞ্জ ও শহর এলাকার বিপুলসংখ্যক ভবন বহু বছর ধরে কাঠামোগত মূল্যায়ন ছাড়াই ব্যবহৃত হচ্ছে। অনেক ভবন অনুমোদিত নকশা অনুযায়ী নির্মিত নয়, আবার অনেক ক্ষেত্রে অনুমোদনবিহীন তলা বৃদ্ধি করা হয়েছে। ফলে মাঝারি মাত্রার কম্পনেও এসব ভবনে বড় ধরনের ক্ষতি হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
শুক্রবারের কম্পনের পর সিদ্ধিরগঞ্জ থানার বিভিন্ন এলাকার কয়েকটি বাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ফাটল দেখা গেছে বলে জানিয়েছে স্থানীয়রা। শনিবার সন্ধ্যায় নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক এসব স্থানে পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। সেই সাথে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স সংশ্লিষ্ট এলাকা পরিদর্শন করে ক্ষয়ক্ষতির প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহ করছে। গ্যাস লাইন লিকেজ, বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে যাওয়া এবং ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে প্রবেশে সতর্কতা জারি করা হয়েছে।
বাংলাদেশে সক্রিয় পাঁচটি প্রধান ফল্ট লাইন রয়েছে—মিয়ানমার থেকে নোয়াখালী পর্যন্ত প্লেট বাউন্ডারি–১, নোয়াখালী থেকে সিলেট পর্যন্ত প্লেট বাউন্ডারি–২, সিলেট থেকে ভারতের দিকের প্লেট বাউন্ডারি–৩, ডাউকি ফল্ট এবং মধুপুর ফল্ট। এসব ফল্ট শতবছর ধরে শক্তি সঞ্চয় করছে বলে গবেষণা বলছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব ফল্টের যে কোনো একটি বড় মাত্রায় সরে গেলে ঘনবসতিপূর্ণ ঢাকা–নারায়ণগঞ্জ শিল্পাঞ্চল সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
ঐতিহাসিক ভূমিকম্পের রেকর্ড বিশ্লেষণ করলেও সতর্কতার প্রয়োজনীয়তা স্পষ্ট হয়। ১৭৬২ সালের ভূমিকম্প, ১৮৮৫ সালের মানিকগঞ্জ কম্পন, ১৮৯৭ সালের গ্রেট ইন্ডিয়ান আর্থকোয়েক, ১৯১৮ সালের শ্রীমঙ্গল ভূমিকম্প, ১৯৯৭ সালের চট্টগ্রাম কম্পন এবং ১৯৯৯ সালের মহেশখালীর ভূমিকম্প—প্রতিটি ঘটনায় দেশের ভূতাত্ত্বিক দুর্বলতা স্পষ্ট হয়েছে। বিশেষ করে নরম পলিমাটির উপর দাঁড়ানো ঢাকার মতো নারায়ণগঞ্জেও মাঝারি মাত্রার ঝাঁকুনিতেই ভবনের কাঠামোগত ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ ভূমিকম্পে সারা দেশে আহত হয়েছেন সাড়ে চারশ জনেরও বেশি মানুষ। গাজীপুরে সর্বোচ্চ ২৫২ জন আহত হয়েছেন, যার বড় অংশই আতঙ্কে ভবন থেকে নামার সময় আঘাতপ্রাপ্ত।
স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম বলেছেন, মানুষের অপ্রস্তুত অবস্থাই আহতের সংখ্যা বাড়িয়ে দিয়েছে। তিনি বলেন, পরবর্তী কয়েক দিনে আরও আফটারশক হতে পারে, তাই জনসচেতনতা জরুরি।
সরকার জানিয়েছে, ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা চিহ্নিত করে দ্রুত সহায়তা, পুনর্বাসন এবং ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা হালনাগাদ করা হবে। পাশাপাশি শিল্পাঞ্চল নারায়ণগঞ্জে গার্মেন্টস ভবন, বাণিজ্যিক ভবন এবং আবাসিক স্থাপনার কাঠামোগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিশেষ নজরদারি চালানো হবে।
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, মাঝারি ঝুঁকিতে থাকা নারায়ণগঞ্জে তাত্ক্ষণিকভাবে ভবনের কাঠামোগত মূল্যায়ন, প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন, জরুরি বহির্গমন পথ নিশ্চিতকরণ এবং নিয়মিত ভূমিকম্প মহড়া আয়োজন করা প্রয়োজন। তাদের মতে, ভূমিকম্পের মাত্রা ছোট হলেও সতর্ক না থাকলে ক্ষয়ক্ষতি বড় হতে পারে।

