রোববার, ২০ জুলাই ২০২৫

|

শ্রাবণ ৪ ১৪৩২

Advertisement
Narayanganj Post :: নারায়ণগঞ্জ পোস্ট

নারায়ণগঞ্জে ১৪ চক্র, আট বছরে ৬৩ চালক খুন, ৫৭৭ ছিনতাই

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

প্রকাশিত: ১১:৫৮, ২০ জুলাই ২০২৫

নারায়ণগঞ্জে ১৪ চক্র, আট বছরে ৬৩ চালক খুন, ৫৭৭ ছিনতাই

প্রতীকী ছবি

নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ উপজেলার কেওডালা গ্রামের সাগর মিয়া ছেলেবেলায় মা হুমাইরা বেগমকে হারান। বাবা শফিক মিয়াও পঙ্গু। বাবা ও দুই ভাই-বোনের সংসার টানতে তাঁর একমাত্র অবলম্বন ছিল একটি ইজি বাইক। ভাগ্যবদলের এ বাহনটিই তাঁর মৃত্যুর কারণ হয়ে ওঠে।

২০২০ সালের ১৮ জুলাই রাতে রাজধানীর ৩০০ ফিট সড়কে দুর্বৃত্তরা গলা কেটে তাঁকে হত্যা করে তাঁর ইজি বাইকটি নিয়ে যায়। হত্যাকাণ্ডের পাঁচ বছরেও অপরাধীরা ধরা পড়েনি। সাগরের বৃদ্ধা দাদি সাহারা বানু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চালাচ্ছেন ভাঙা সংসার। শুধু সাগর নন, নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ, আড়াইহাজার, সোনারগাঁও, বন্দর, ফতুল্লা ও সিদ্ধিরগঞ্জ থানার বিভিন্ন এলাকায় এভাবে প্রতিনিয়ত চালক খুন হচ্ছেন, ছিনতাই হচ্ছে তাঁদের ইজি বাইক।

একমাত্র উপার্জনকারীর প্রাণহানিতে বেশির ভাগ পরিবারই বিপন্ন হয়ে পড়েছে।

থানার পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থা, পিবিআইয়ের তথ্য বলছে, আট বছরে জেলায় ইজি বাইকের কমপক্ষে ৬৩ জন চালক খুন হন। একই সময়ে ছিনতাই করা হয় ৫৭৭টি ইজি বাইক। এর বিপরীতে থানাগুলোতে ইজি বাইক ছিনতাইয়ের মামলা করেছেন ১৩২ জন চালক।

চলতি বছরের গত মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে তিনজন ইজি বাইক চালক খুন হন। ভুক্তভোগীরা জানান, ইজি বাইক ছিনতাই হলেও অনেকে থানায় হয়রানি, আদালতে দৌড়ঝাঁপ, অর্থসংকট, সাক্ষী না পাওয়াসহ নানা কারণে সব ঘটনায় মামলা করতে আগ্রহ দেখান না। পুলিশ বলছে, প্রকৃত ঘটনার তুলনায় মামলা কম হচ্ছে। জানা গেছে, জেলায় ইজি বাইক ছিনতাইয়ে ১৪টি চক্র রয়েছে।

ধাপে ধাপে সাজানো হয় হত্যার পরিকল্পনা : অনুসন্ধানে জানা গেছে, ছিনতাইকারীচক্রের প্রথম দল চালককে টার্গেট করে তাঁর বাসাবাড়ি ও গাড়ির গ্যারেজ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে।

এরপর চালকের মোবাইল ফোন নম্বর সংগ্রহ করে দ্বিতীয় দলকে দেয়। দলটি গাড়ির গ্যারেজের আশপাশে অবস্থান নেয়। দিনভর গাড়ি চালিয়ে চালক রাতে গাড়ি গ্যারেজে রাখার সময় দলটির সদস্যরা যাত্রীবেশে গাড়িতে ওঠে। লোভনীয় ভাড়ার কথা বলে নির্জন এলাকায় নিয়ে পরে চালককে হত্যা করা হয়। কখনো গলায় গামছা পেঁচিয়ে শ্বাসরোধে বা ছুরিকাঘাতে হত্যাকাণ্ড চালানো হয়। মৃত্যু নিশ্চিত করে চালকের মরদেহ সড়কের পাশে ফেলে ইজি বাইক নিয়ে পালিয়ে যায় তারা।

বিভিন্ন ঘটনার ধারাবাহিকতা পর্যালোচনায় পুলিশ দেখতে পেয়েছে, চালককে হত্যার পর চক্রের তৃতীয় দলটি পৌঁছে গাড়ির কাছে। তারা গাড়ির রং ও আনুষঙ্গিক সরঞ্জাম পরিবর্তন করে সেটি বিক্রি করে দেয়। বিক্রির পর অর্ধেক টাকা যায় দ্বিতীয় দলটির কাছে, বাকি টাকা চক্রের অন্যান্য সদস্য ভাগ করে নেয়। আবার একটি অংশ ছিনতাইয়ে নিজের স্ত্রী বা নারী আত্মীয়দের কাজে লাগায়। রাত হলে ওত পেতে থাকা নারী ইজি বাইক ভাড়া নেয়। চুক্তি অনুয়ায়ী তারা ইজি বাইক চালককে ছিনতাইকারীর অবস্থান পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। পরে তাদের কমিশন নিয়ে সটকে পড়ে।

এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়া ইজি বাইক চালক মনির হোসেন জানান, এক মাস আগে রাত ১০টায় কাঞ্চন থেকে মধ্যবয়সী এক নারী তাঁর গাড়িতে ওঠেন। ওই নারী তাঁকে পূর্বাচলের ৯ নম্বর সেক্টরে নিয়ে যেতে বলেন। পূর্বাচলে ঢোকার পর দূর থেকেই কয়েকজন যুবককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মনিরের সন্দেহ হয়। পরে তিনি ওই নারীকে গাড়ি থেকে নেমে যেতে বললে নারী যাত্রীটি চিৎকার শুরু করে। ওই সময় যুবকরা এগিয়ে আসতে থাকলে মনির নারীকে ধাক্কা দিয়ে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়ে দ্রুত ইজি বাইক চালিয়ে প্রাণে রক্ষা পান।

প্রায় এক মাস আগে রূপগঞ্জের নগরপাড়ার আমজাদ হোসেনকে অজ্ঞান করে তাঁর কাছ থেকে ইজি বাইক নিয়ে যায় ছিনতাইকারীরা। আমজাদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ছিনতাইকারীরা আমার সব শেষ কইরা দিছে। মালিককে ধার করে ৬০ হাজার টাকা দিতে হয়েছে। এখন কেস (মামলা) কইরা কী অইব?’

ছিনতাইকারীদের হাতে নিহত ছয়জন ইজি বাইক চালকের পরিবারের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তাঁরা জানান, কেউ ঋণ নিয়ে, কেউ হালের বলদ, কেউ স্বর্ণ বিক্রি করে ইজি বাইক কিনেছিলেন। কেউ কেউ পরিবারের শেষ সম্বল জমি বিক্রি করেও কিনেছিলেন। ইজি বাইক ছিনতাই হওয়ায় তাঁরা নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। ২০২২ সালের ১৭ মে নিহত তারাব পৌরসভার নোয়াপাড়ার ইজি বাইক চালক কুরবান আলীর বাবা নুর মোহাম্মদ বলেন, ‘মামলা তো করছিলাম। কী অইব? কিছুই অইব না। পুত (ছেলে) গেছে, পুত কি আর ফিরা পাইমু (পাব)।’

২০২৪ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি সোনারগাঁও উপজেলার পিরোজপুর ইউনিয়নের পিরোজপুর গ্রামের নিহত চালক রজ্জব আলীর ছেলে সানাউল্লাহ মিয়া বলেন, ‘কী দোষ আছিল আমার বাবার? শুধু গাড়িটা নিয়া নিতে পারত। আমাগো ক্যান এতিম কইরা দিল?’

অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত আট বছরে যে ৬৩ জন ইজি বাইক চালক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন তার মধ্যে দুটি ঘটনার বিচার হয়েছে। বেশ কিছু হত্যাকাণ্ডের পর গ্রেপ্তার করা হলেও আসামিরা জামিনে বেরিয়ে এসেছে। নারায়ণগঞ্জ আদালত সূত্রে জানা গেছে, ২০০৫ সালে রূপগঞ্জের আধুরিয়ায় ইজি বাইক চালক হাদী দাউদ হত্যা মামলার রায় গত ১১ মার্চ প্রদান করেছেন আদালত। রায়ে ছিনতাইকারী লতিফ, রতন, আউয়াল ও শহীদুলকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ দ্বিতীয় আদালতের বিচারক হুমায়রা তাসমিন। ২০২০ সালের ২৯ মার্চ আড়াইহাজার উপজেলার মারুয়াদীর ইজি বাইক চালক জামান মিয়া হত্যা মামলায় গত ১৪ মে আদালত রায়  দেন। রায়ে আক্তার হোসেন, সাইফুল ইসলাম ও বাদশা মিয়াকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন জেলা ও দায়রা জজ শামীম আজাদ।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জজুড়ে গড়ে উঠেছে ৫৪টি গ্যারেজ। ছিনতাই হওয়া গাড়িগুলোর বেশির ভাগ এসব গ্যারেজে রাখা হয়। কয়েকটি গ্যারেজের মালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, তাঁরা কম দামে ইজি বাইক কিনে রাখেন। কেনার পর এসব গাড়ির চেহারা পাল্টে ফেলেন। পরে তা আবার চড়া দামে বিক্রি করেন। তাঁরা জানান, ছিনতাইকারীচক্রের সদস্যদের বেশির ভাগের বাড়ি চাঁদপুর, নোয়াখালী, মুন্সীগঞ্জে।

নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থানার ওসি শফিকুল ইসলাম বলেন, এক বছরে সব মামলা পর্যালোচনা করে পরিস্থিতি সম্পর্কে পুলিশ অবগত হয়েছে। রূপগঞ্জ থানার ওসি তরিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা পরিস্থিতি নজরদারিতে রেখেছি।’ জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (গ সার্কেল) মেহেদী হাসান বলেন, ‘ইজি বাইকের নিবন্ধন না থাকাই বড় সমস্যা। আমরা চালকদের নির্জন এলাকায় না যেতে, রাতের বেলা সাবধানে গাড়ি চালানোর পরামর্শ দিচ্ছি।’

পিবিআই নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার মো. মোস্তফা কামাল রাশেদ বলেন, ইজি বাইক ছিনতাই ভয়ংকর পর্যায়ে পৌঁছেছে। প্রতিটি থানা এলাকায় আলাদা চক্র রয়েছে, যারা তিন ভাগে কাজ করে। রূপগঞ্জে ছিনতাই হলে তা বিক্রি হয় সোনারগাঁওয়ে। আড়াইহাজারের গাড়ি যায় ফতুল্লায়। গ্যারেজগুলোতে বিক্রি করে রং পাল্টে ফের সড়কে নামানো হয়।

নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার প্রত্যুষ কুমার মজুমদার বলেন, নারায়ণগঞ্জে চালক হত্যার বেশ কয়েকটির রহস্য উদঘাটন করা হয়েছে।