
ফাইল ছবি
চট্টগ্রাম থেকে ট্রাকভর্তি পণ্য নিয়ে নারায়ণগঞ্জের শিমরাইলে পৌঁছাতেই ভোর হয়ে যায়। সাভারে যেতে আরও সময় লাগবে। তাই বিশ্রাম নিতে শিমরাইলের আন্তঃজেলা ট্রাক টার্মিনাল ঢুকতে যান চালক মো. আবুল হোসেন। কিন্তু গর্ত দেখে ভেতরে যাওয়ার সাহস পাননি। বাধ্য হয়ে টার্মিনালের পাশেই মহাসড়কে দাঁড় করিয়ে রাখেন ট্রাকটি।
পাশেই ব্যস্ত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক। আবুল হোসেনের ট্রাকের মতো বেশ কিছু ট্রাক সোমবার বেলা ১১টার দিকে দেখা যায় এভাবে সারিবদ্ধ। এতে দুর্ঘটনার ঝুঁকি থাকে বলে জানান পরিবহন শ্রমিকরা। কিন্তু তারা অনেকটা বাধ্য হয়েই সড়কের পাশে যানবাহন থামিয়ে বিশ্রাম নেন। আবুল হোসেন বলেন, টার্মিনালের ভেতরে যাওয়ার চিন্তাই করছিলেন। কিন্তু গর্তে ট্রাক ফেঁসে গেলে তুলতে বহু গুণ যন্ত্রণা পোহাতে হবে ভেবেই তিনি বাইরে পার্ক করেন।
টার্মিনালটি পুরোপুরি কাঁচা। চলতি বর্ষায় সেখানে কাদাপানি গড়াগড়ি খাচ্ছে বড় বড় গর্তে। অথচ প্রতিদিন শত শত ট্রাক আসে এই টার্মিনালের রাখার জন্য। মহাসড়কের পাশে হওয়ায় বিভিন্ন জেলার খালি ও ভরা ট্রাক নিয়ে আসেন চালকরা। কিন্তু এখন টার্মিনালটি দেখলে যেন মনে হয়, খাল বা ফসলের জন্য চষে রাখা ক্ষেত। তবু প্রতিদিন ট্রাক রাখলে এখানে দিতে হয় ৫০ টাকা চাঁদা।
ট্রাকচালক মো. বাবুলের ভাষ্য, টার্মিনালের সংস্কার হচ্ছে না দীর্ঘ দিন। বৃষ্টির এই সময়ে তারা ট্রাক রাখতে গিয়ে চরম দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন।
পরিবহন শ্রমিক শাহ আলমসহ কয়েকজন জানান, এই টার্মিনাল ব্যবহারের প্রায় অনুপযোগী। ভেতরে যে গভীর গর্ত, সেগুলোতে পণ্যবাহী ট্রাক পড়লে সহজে ওঠানো যায় না। প্রায়ই এক্সেল ভেঙে যায়। নষ্ট হয় অন্যান্য যন্ত্রাংশ। কখনও কখনও ট্রাক টেনে তুলতে রেকার ভাড়া করতে হয়। বাধ্য হয়ে অনেক চালক এখন টার্মিনালে ট্রাক না রেখে ঝুঁকি নিয়ে মহাসড়কের ওপরেই পার্কিং করেন।
শ্রমিকদের কথার সত্যতা স্বীকার করেন ট্রাকমালিক মো. আলাউদ্দিন। তিনি বলেন, গর্ত ও কাদাপানিতে ভরা টার্মিনালে ট্রাক ঢুকালে যন্ত্রাংশ নষ্ট হয়। তাই তারা সেখানে ট্রাক রাখার আগে কয়েকবার চিন্তা করেন।
গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর টার্মিনালের মালিক সমিতি ও শ্রমিক সংগঠনের নেতৃত্বে পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু তারাও টার্মিনাল সংস্কারের উদ্যোগ নেননি। বাধ্য হয়ে বেহাল টার্মিনালেই ট্রাক রাখতে হয়। উল্টো নিরাপত্তাকর্মীদের নাম করে প্রতি ট্রাক থেকে চাঁদা তোলা হচ্ছে ৫০ টাকা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক শ্রমিকের ভাষ্য, এখানে দিনে গড়ে ২০০ ট্রাক রাখা হয়। সে হিসাবে দৈনিক আয় হয় ১০ হাজার টাকার মতো, যা মাসে তিন লাখ টাকায় দাঁড়ায়। অথচ এখানে নিরাপত্তার দায়িত্বে আছেন আটজন। তারা মাসিক বেতন পান ৮-১০ হাজার টাকা করে। ওই টাকা দিয়ে বাকি টাকা লোপাট করছেন নেতারা।
এ বিষয়ে কথা হয় বাংলাদেশ ট্রাক, কাভার্ডভ্যান ও পিকআপ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. সেন্টু ব্যাপারীর সঙ্গে। টার্মিনালের সংস্কার বিষয়ে তহবিল নেই বলে জানান তিনি। মালিক সমিতি কোনো চাঁদা তোলে না জানিয়ে সেন্টু ব্যাপারী বলেন, টার্মিনালের নৈশপ্রহরীদের বেতনের জন্য ট্রাকপ্রতি ৫০ টাকা চাঁদা তোলে শ্রমিক কমিটি। এ ছাড়া কোনো চাঁদা নেওয়া হয় না।
টার্মিনালে বর্তমানে শ্রমিকদের নির্বাচিত কমিটি নেই। তবে গত বছর ৫ আগস্টের পর দায়িত্ব নিয়েছেন আন্তঃজেলা ট্রাকচালক শ্রমিক ইউনিয়নের শিমরাইল শাখার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আইয়ুব আলী মুন্সী। তাঁর ভাষ্য, এখানে কোনো চাঁদা আদায় নেই। তবে টার্মিনালের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আটজন নৈশপ্রহরীর বেতনের জন্য প্রতি ট্রাক থেকে ৫০ টাকা নেওয়া হচ্ছে। অন্য কোনো চাঁদা তোলা হয় না। টার্মিনালের অবস্থা খারাপ থাকায় দিনে ৫০-৬০টি ট্রাকের বেশি আসে না দাবি করে তিনি বলেন, প্রহরীদের বেতন দিতেই হিমশিম খাচ্ছেন।
টার্মিনালের সংস্কার বিষয়ে আইয়ুব আলী মুন্সীর ভাষ্য, ‘ইতোপূর্বে বিল্ডিং ভাঙা রাবিশ (ভাঙা ইট-খোয়া-কংক্রিট) ফেলেছি। এখন বর্ষাকাল, তাই সংস্কার কাজ করা যাচ্ছে না। নারায়ণগঞ্জ সড়ক ও জনপথ বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মাঠ সংস্কার বিষয়ে আলোচনা করেছি। তাদের চিঠি দিয়ে অনুরোধ জানাব।’
নারায়ণগঞ্জ সওজ বিভাগের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মোহাম্মাদ আহসান উল্ল্যাহ মজুমদার বলেন, শিমরাইল ট্রাক টার্মিনালটি সওজ বিভাগের জমিতে। মহাসড়কে ট্রাক রাখলে দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকে। তাই জায়গাটি তাদের লিখিত ছাড়াই ব্যবহার করতে দেওয়া হয়েছে। তারা টার্মিনালটি সংস্কারে চিঠি দিলে কর্তৃপক্ষ বিষয়টি বিবেচনা করবে।