
ফাইল ছবি
কখনও ঋণ নিয়ে, কখনও ঋণপত্র খুলে আবার কখনও গম সরবরাহের চুক্তি দেখিয়ে ব্যাংক থেকে শত শত কোটি টাকা তুলে নিয়েছেন ঢাকা ট্রেডিং হাউসের মালিক টিপু সুলতান। নানা কৌশলে ঋণের টাকা হাতিয়ে নেওয়ায় তিনি খ্যাতি পান ‘ঋণের সুলতান’ হিসেবে। আত্মসাতের বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ায় তাঁর বিরুদ্ধে পৃথক দুটি মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
এছাড়া জনতা ব্যাংকের ৬৯২ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ আদায়ে টিপু সুলতানের বিরুদ্ধে ৮টি মামলা করেছে ব্যাংক। একটি মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন আদালত। পরোয়ানা মাথায় নিয়ে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, কুষ্টিয়া ও বগুড়ায় ভোটের প্রচার করছেন টিপু। তাঁর এবারের লক্ষ্য কাঁচাপাট রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ জুট অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএ) নির্বাচনে পরিচালক হওয়ার। আগামী শনিবার নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকা কেন্দ্রে এই ভোট অনুষ্ঠিত হবে।
খুলনার পাট রপ্তানিকারকরা জানান, বিগত বছরগুলোতে ভোট ছাড়াই বিজেএর নেতা ঠিক করে দিতেন আওয়ামী লীগ নেতারা। দীর্ঘদিন পর এবার ভোট হচ্ছে। এই সুযোগে অ্যাসোসিয়েশনের নেতা হওয়ার দৌড়ে এগিয়ে গেছেন ঢাকা ট্রেডিংয়ের টিপু সুলতান। ইতোমধ্যে তিনি বিএনপি সমর্থিত প্যানেলে জায়গা করে নিয়েছেন। প্যানেলের নির্বাচনী ব্যয়ের কিছু অংশ তিনি বহন করছেন। নির্বাচনে বিজয়ী হতে পারলে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করাসহ বিভিন্ন পরিকল্পনার কথা ভোটারদের জানাচ্ছেন তিনি।
জনতা ব্যাংক থেকে জানা গেছে, ঋণের ৩৪০ কোটি টাকা চেয়ে ২০১৩ সালে টিপু সুলতানের বিরুদ্ধে প্রথম মামলা করে ব্যাংক। পরবর্তীকালে তাঁর বিরুদ্ধে ৭টি চেক প্রত্যাখ্যাতের মামলা এবং অর্থঋণ আদালতে আরেকটি মামলা করা হয়। একটি মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি আদালত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। কিন্তু পরোয়ানা তামিলের বিষয়ে দৃশ্যমান পদক্ষেপ দেখা যায়নি।
জনতা ব্যাংক থেকে ২৫০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ২০১৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি টিপু সুলতানসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন দুদকের উপ-পরিচালক মো. সামছুল আলম। ওই বছরের ৩০ মার্চ এই মামলায় টিপু সুলতানকে গ্রেপ্তার করা হয়। ২০১৯ সালের ১২ জুন বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (বিডিবিএল) প্রিন্সিপাল শাখার প্রায় ৩০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে তিনিসহ চারজনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে দুদক।
এছাড়া এবি ব্যাংক পাবে ৭০ কোটি, এক্সিম ব্যাংক ১৫০ কোটি, সাউথইস্ট ব্যাংক ৫০ কোটি, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক ৩০ কোটি টাকা ঋণ রয়েছে টিপু সুলতানের। এর অনেক টাকাই এখন খেলাপি।
মামলাগুলোর বিষয়ে খোঁজ নিয়ে দুদক কর্মকর্তারা জানান, দুটি মামলায় টিপু সুলতানের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে।
জনতা ব্যাংকের আইনজীবী মফিজুল ইসলাম বলেন, ঢাকা ট্রেডিংয়ের বিরুদ্ধে চেক ডিজঅনার একটি মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। পরোয়ানা এখনও তামিল করা হয়নি।
পাট রপ্তানিকারকরা জানান, বিভিন্ন ব্যাংকের টাকা আত্মসাতে অভিযুক্ত হয়ে খুলনায় ফিরে পাট রপ্তানিতে মনোযোগ দেন টিপু সুলতান। গত কয়েক বছর ধরে পাট রপ্তানিকারকদের মধ্যে শীর্ষ অবস্থান ধরে রেখেছেন তিনি। নির্বাচনের তোড়জোড় শুরু হওয়ার পর থেকে নিজের পরিচিত ব্যবসায়ী ও আত্মীয়স্বজনকে ভোটার করেন টিপু সুলতান।
তারা জানান, পাট ব্যবসায় প্রভাবশালী হওয়ায় নির্বাচনের আগে তাঁকে নিজেদের প্যানেলে নিয়ে নেন বিএনপি সমর্থিত ব্যবসায়ীরা। তাদের প্যানেলে দৌলতপুর থানা আওয়ামী লীগের সদস্য ও বিজেএর বর্তমান চেয়ারম্যান ফরহাদ আহমেদ আকন্দ পম্পিও রয়েছেন। প্যানেলে আছেন দৌলতপুর থানা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ইমাম হোসেন। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি একসঙ্গে থাকায় নির্বাচনের দৌড়ে এগিয়ে গেছে প্যানেলটি।
ব্যবসায়ীরা জানান, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সবচেয়ে বড় পাটের মোকাম ছিল দৌলতপুর। পাট রপ্তানিকারকদের হাত ধরে সেখানে জুট মিল ও জুট প্রেস গড়ে ওঠে। নানা কারণে অধিকাংশ জুট প্রেস বন্ধ হয়ে গেছে। বেশির ভাগ পাট ব্যবসায়ী ঋণ খেলাপি হয়ে পড়েন। তারাও নির্বাচনে ভোটার হয়েছেন; যার কারণে ঋণখেলাপিদের প্রতিনিধি হিসেবে অনেকে ভোটে দাঁড়াচ্ছেন।
প্যানেলের প্রধান খোন্দকার আলমগীর কবির বলেন, কেউ ইচ্ছে করে ঋণ খেলাপি হন না। পাট রপ্তানি বন্ধ, সরকারের আজগুবি শর্তের কারণে অনেকে সময়মতো পাট রপ্তানি করতে পারেননি। দাম কমে যাওয়ায় লোকসানে অনেকে খেলাপি হয়েছেন। সরকারের কাছ থেকে সহযোগিতা নিয়ে তাদের আবার মূল ব্যবসায় ফিরিয়ে আনাই আমাদের লক্ষ্য। টিপু সুলতান এই কাজ ভালো বোঝেন, তাই তাঁকে সঙ্গে রাখা হয়েছে।
তিনি বলেন, ব্যাংকের সঙ্গে ঝামেলার বিষয়টি আমরা জানি, এর বাইরে টিপু সুলতান ভালো ব্যবসায়ী। তিনি আলাদা প্যানেল দিলে ভোট কঠিন হয়ে যেত। এছাড়া খেলাপি, রপ্তানিকারকদের সবাইকে নিয়ে আমাদের চলতে হয়।
এসব অভিযোগের ব্যাপারে টিপু সুলতান সমকালকে বলেন, ব্যবসায়ীদের অনুরোধেই প্রার্থী হয়েছি। প্রার্থী যখন হয়েছি, ভোট চাইছি। মামলাগুলো স্থগিতাদেশ রয়েছে। শারীরিক অসুস্থতা দাবি করে বিষয়গুলো নিয়ে আর কথা বলতে চাননি তিনি।