শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪

|

বৈশাখ ৫ ১৪৩১

Advertisement
Narayanganj Post :: নারায়ণগঞ্জ পোস্ট

অগ্নিঝুঁকিতে নারায়ণগঞ্জের হোসিয়ারি পল্লি

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

প্রকাশিত: ১৮:৩০, ১২ মে ২০২৩

অগ্নিঝুঁকিতে নারায়ণগঞ্জের হোসিয়ারি পল্লি

ফাইল ছবি

প্রাচীনকাল থেকেই বাণিজ্যিক নগরী হিসেবে পরিচিত নারায়ণগঞ্জ। শহরের নয়ামাটিতে অর্ধশত বহুতল ভবনে রয়েছে প্রায় দুই হাজার ২০০ হোসিয়ারি কারখানা। প্রতিদিন কয়েকশ কোটি টাকার হোসিয়ারি পণ্যের বেচাকেনা হয় এখানে। অথচ এসব কারখানার একটিতেও অগ্নিনির্বাপণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। মাত্র দুইটি সরু গলি ঘেঁষে গড়ে উঠেছে জমজমাট হোসিয়ারি ও থান কাপড়ের ব্যবসা। কিন্তু বাণিজ্যিক এলাকাগুলোর মধ্যে নিরাপত্তার দিক থেকে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা এটি। অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা ঘিঞ্জি বাণিজ্যিক এলাকাটি নারায়ণগঞ্জের সবচেয়ে অগ্নি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা।

হোসিয়ারি ব্যবসায়ীদের মতে, অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা নারায়ণগঞ্জের নয়ামাটি এলাকা সবচেয়ে অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে। এই এলাকা এতটাই অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে যে আগুন লাগলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লেগে যাবে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে। অপরিকল্পিতভাবে ভবনগুলো নির্মাণ করার ফলে আগুন লাগলে মুহূর্তের মধ্যে অন্য ভবনে ছড়িয়ে যাবে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে   পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা না থাকায় এখনে অগ্নিঝুঁকি সবচেয়ে বেশি।  অগ্নিনির্বাপণের জন্য যে ব্যবস্থা রয়েছে এগুলো দিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না। ফলে যেকোনো ছোট অগ্নিকাণ্ড ভয়াবহ রূপ নেয়ার আশঙ্কা ব্যবসায়ীদের।

তবে নারায়ণগঞ্জের হোসিয়ারি পল্লি নয়ামাটিকে অগ্নিঝুঁকি থেকে বাঁচাতে নানা উদ্যোগ নেয়ার কথা জানিয়েছেন হোসিয়ারি শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। নয়ামাটি হোসিয়ারি পল্লিকে ঝুঁকিমুক্ত করে কীভাবে আধুনিকায়ন করা যায় সেই পরিকল্পনা করছে তারা। ঝুঁকি কমাতে কী কী ব্যবস্থা নেয়া যায় এ বিষয়ে শ্রম অধিদপ্তর, বিসিক, ফায়ার সার্ভিস, ডিপিডিসিকে তদন্ত করে প্রতিবেদন দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

সরেজমিন দেখা গেছে, নয়ামাটি এলাকায় যে ভবনগুলোতে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে সেই ভবনগুলোর প্রায় ৯০ ভাগই একটির সঙ্গে ঘেঁষে আরেকটি ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। দু’টি ভবনের মধ্যে নির্দিষ্ট জায়গা ফাঁকা রাখার নিয়ম থাকলেও সেই নিয়মকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এক দেয়ালেই দু’টি ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। সরুপথ দিয়ে মালামাল আনা নেয়া করছে হোসিয়ারি শ্রমিকরা।

জানা গেছে, দোকানপাটগুলোতে রাখা হয় না অগ্নিনির্বাপক মেশিন, বালু বা পানির ব্যবস্থা যাতে অগ্নিকাণ্ডের শুরুতেই নিজস্ব সক্ষমতায় সেটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়। প্রতিদিন এ মার্কেটে হাজার হাজার ক্রেতা ও সাধারণ মানুষের যাতায়াত করলেও সে তুলনায় রাস্তাগুলো অত্যন্ত সঙ্কুচিত। এর মধ্যে রাস্তাগুলোর প্রবেশ পথে গড়ে উঠেছে অবৈধ দোকানপাট। সঙ্কুচিত রাস্তা এবং প্রবেশ মুখে অবৈধ দোকানপাটের কারণে ফায়ার সার্ভিসের গাড়িগুলো ভেতরে প্রবেশ করতে পারবে না।

হোসিয়ারি মালিক মজিবুর রহমান জানান, নয়ামাটি দেশের বৃহৎ হোসিয়ারি ব্যবসাকেন্দ্র অথচ এখানের রাস্তাগুলো খুবই সরু। আমরা সবসময় অগ্নিঝুঁকিতে থাকি। বড় কোনো অগ্নিকাণ্ড ঘটলে অনেক ক্ষতির মুখে পড়তে হবে ব্যবসায়ীদের।

তিনি বলেন, ‘এখানে ভবনগুলো একটির সঙ্গে আরেকটি লাগানো। মাঝে কোনো ফাঁকা জায়গা নেই। একটি ভবনেও পানির জন্য আন্ডারগ্রাউন্ড রিজার্ভার নেই। ২৫ ফুট রাস্তার প্রয়োজন। কিন্তু নয়ামাটির রাস্তা হচ্ছে ৬ থেকে ৭ ফুট। এছাড়া ভবনগুলো রাস্তার ওপরে নির্মাণ করা হয়েছে। যে কারণে ফায়ার সার্ভিসের কোনো গাড়ি যেতে পারে না। বৈদ্যুতিক সংযোগগুলোও এলোমেলো। অবৈধ সংযোগ আছে। এসব কারণে নয়ামাটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা।’

নারায়ণগঞ্জ কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের উপ-মহাপরিদর্শক ড. রাজীব চন্দ্র দাস বলেন, নারায়ণগঞ্জে আমাদের হোসিয়ারি সেক্টর পুরোটাই অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে। এখানে শিশু শ্রমিক আছে এবং নিরাপত্তা ঝুঁকিও আছে। ফায়ারের কোনো সেফটি নাই। অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটলে মানুষ যে বের হয়ে আসবে তাও সম্ভব না। তাই এখানে আমাদের লাইসেন্স দেয়াও বন্ধ আছে। বন্দরে একটি ইপিজেড হওয়ার কথা। তাদের সেখানে স্থানান্তর করার একটি পরিকল্পনা আছে। কারণ দুর্ঘটনা ঘটে গেলে অনেক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

মণ্ডলপাড়া ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক ফখরুদ্দিন আহম্মেদ বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জ শহরের নয়ামাটি এবং এর নিকটবর্তী প্রতিটি হোসিয়ারি পল্লি ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্যে আছে। আমরা মাঝে মাঝে ভাবি যদি এখানে কোনো বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ড কিংবা অন্য কোনো দুর্ঘটনা হয়, তাহলে আমরা কী করব! এই হোসিয়ারি পল্লিগুলোর রাস্তাঘাট সরু। আগুন লাগলে ফায়ার সার্ভিসের গাড়িও ঢুকবে না। যেসব দালান ও বিল্ডিংয়ে হোসিয়ারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তার বেশির ভাগই মেয়াদোত্তীর্ণ এবং জরাজীর্ণ অবস্থায় আছে। তাই যদি এ প্রতিষ্ঠানগুলো এখান থেকে সরিয়ে নেয়া হয় বা স্থানান্তর করা হয়, তাহলে তো খুবই ভালো হবে। আমিও মনে করি এটাই করা উচিত। নইলে বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে দেখা যাবে কেউ এর দায় নেবে না।’

এর আগে নয়ামাটিতে অগ্নিঝুঁকি নিয়ে নারায়ণগঞ্জ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপসহকারী পরিচালক আব্দুল্লাহ আল আরেফিন জানিয়েছিলেন, ‘২০২০ সালে নয়ামাটি এলাকায় জরিপ করেছিলাম। সেখানে প্রায় অর্ধশত বহুতল ভবন রয়েছে যেগুলোতে প্রায় দুই হাজার ২০০ হোসিয়ারি রয়েছে। একটিতেও অগ্নিনির্বাপণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। তখন আমরা নোটিশ দিয়েছিলাম। কিছু পরিবর্তন এসেছে; কিন্তু ঝুঁকি কমেনি।

উল্লেখ্য, ১৯২১ সালে বাবু সতীশ চন্দ্র পাল নারায়ণগঞ্জের টানবাজারে প্রথম হোসিয়ারি কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন।