ফাইল ছবি
মিডিয়াকে আটকে রাখা বা অন্ধকারে রাখার কোনো সুযোগ নেই বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন বিএফইউজের সভাপতি ওবায়দুর রহমান শাহিন। তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেন, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে আর একটি মামলাও হলে কিংবা সাংবাদিকদের উদ্দেশে একটি টু শব্দ উচ্চারিত হলেও নিবন্ধিত নারায়ণগঞ্জ সাংবাদিক ইউনিয়নের পাশে কেন্দ্রীয়ভাবে দাঁড়াবে বিএফইউজে। প্রয়োজনে প্রশাসনের এসপি ডিসি কীভাবে এখানে থাকে সেটাও দেখা হবে।
শনিবার (২৭ ডিসেম্বর) শহরের সিনেমুন রেস্টুরেন্টে অনুষ্ঠিত নারায়ণগঞ্জ সাংবাদিক ইউনিয়নের দ্বিবার্ষিক সাধারণ সভা-২০২৫ এ প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন তিনি। সাংবাদিক বিল্লাল হোসেন রবিনের সঞ্চালনায় সভায় সভাপতিত্ব করেন নারায়ণগঞ্জ সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি আবু সাউদ মাসুদ।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে ওবায়দুর রহমান শাহিন আরও বলেন, জুলাই আন্দোলনের সময় ফ্যাসিস্ট শক্তি দেশের মানুষের কণ্ঠরোধ করতে চাইলেও সাংবাদিকদের কণ্ঠস্বর বন্ধ করতে পারেনি। নতুন বাংলাদেশ গড়ার লড়াইয়ে সাংবাদিকদের ভূমিকা অপরিসীম উল্লেখ করে তিনি বলেন, ভেবেছিলাম ৫ আগস্টের পর আর আন্দোলন করতে হবে না, কিন্তু বাস্তবতা হলো এখনো আমাদের আন্দোলনে থাকতে হচ্ছে।
তিনি সদ্য পদত্যাগকারী তথ্য উপদেষ্টার ভূমিকা নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেন। বলেন, তথ্য উপদেষ্টার পেছনের চরিত্র আরও ভয়াবহ। ফ্যাসিস্টদের পত্রিকায় দুটি সাপ্লিমেন্ট দেওয়া হয়েছে, যা গভীর উদ্বেগের বিষয়। নতুন তথ্য উপদেষ্টার প্রতি দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, মিডিয়াকে আটকে রাখা বা অন্ধকারে রাখার কোনো সুযোগ নেই।
সাংবাদিকদের দায়িত্ব প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সততার সঙ্গে কাজ করতে হবে এবং পেশাগত দক্ষতা অর্জন করতে হবে। নতুন প্রজন্মের সাংবাদিকদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি আশা প্রকাশ করেন, নারায়ণগঞ্জ সাংবাদিক ইউনিয়নকে দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংগঠনে রূপ দিতে তারা অগ্রণী ভূমিকা রাখবে।
রাজনৈতিক দলগুলোর উদ্দেশে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বিএফইউজে সভাপতি বলেন, ২৪ এর আন্দোলনে যে আপোষ করা হয়নি, ক্ষমতার স্বার্থে যদি এখন আপোষ করা হয় এবং আধিপত্যবাদকে সুযোগ দেওয়া হয়, তাহলে তা হবে দেশবাসীর সঙ্গে চরম প্রতারণা। দেশবাসী কখনোই তা ক্ষমা করবে না। তিনি বলেন, দুই হাজার ছাত্র জনতার আত্মত্যাগ ও হাজার হাজার আহত মানুষের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত প্রত্যাশা রাজনৈতিক বিভেদের কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ সব রাজনৈতিক দলের প্রতি দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের আহ্বান জানান তিনি।
তারেক রহমানের বক্তব্য উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, সবাইকে নিয়ে দেশ গড়ার যে প্রত্যাশা তিনি ব্যক্ত করেছেন, আমরাও সেই বাংলাদেশই চাই।
সভা শুরুর আগে পবিত্র কোরআন থেকে তেলাওয়াত করেন সংগঠনের সদস্য মনির হোসেন। এরপর মহান মুক্তিযুদ্ধ, ২৪ এর আন্দোলন, ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরীফ উসমান হাদি এবং স্বাধীন বাংলাদেশে নিহত সকল সাংবাদিকের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
নারায়ণগঞ্জ সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক একেএম মাহফুজুর রহমান তার সাংগঠনিক প্রতিবেদনে সভাপতির বিরুদ্ধে বিগত সময়ে সংঘটিত নির্যাতনের বিস্তারিত তুলে ধরেন। তিনি জানান, সভাপতির কলম থামিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে তার বিরুদ্ধে ১৪টি মামলা দায়ের করা হয়েছিল। প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও সাহসী নেতৃত্ব দিয়ে সংগঠনকে ঐক্যবদ্ধ রাখার কথা উল্লেখ করেন তিনি। একই সঙ্গে গত দুই বছরে ইউনিয়নের কার্যক্রমের সার্বিক চিত্র উপস্থাপন করেন।
অর্থ সম্পাদক মুস্তাক আহমেদ শাওন আর্থিক প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন। সদস্যদের সমর্থন ও হাত তোলার মাধ্যমে উভয় প্রতিবেদন সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদিত হয়।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের কোষাধ্যক্ষ খন্দকার আলমগীর হোসেন বলেন, দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে সাংবাদিকরা শাখা গঠনের অনুরোধ জানালেও আমরা যাচাই বাছাই ছাড়া সিদ্ধান্ত নিচ্ছি না। তিনি বলেন, নারায়ণগঞ্জ সাংবাদিক ইউনিয়নের জন্ম হয়েছে সংকট ও লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে। সদস্যরা মানসম্মত গণমাধ্যমে কাজ করেন, এটাই এই সংগঠনের বড় শক্তি।
নারায়ণগঞ্জ চেম্বার অব কমার্সের পরিচালক গোলাম সারোয়ার সাঈদ বলেন, জুলাই আন্দোলনের সময় ইন্টারনেট বন্ধ থাকলেও সাংবাদিকরা নতুন বাংলাদেশ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। তিনি সতর্ক করে বলেন, নতুন বাংলাদেশ যেন নতুন ফ্যাসিবাদের হাতে না পড়ে সে বিষয়ে সাংবাদিকদের সজাগ থাকতে হবে। রাজউক পরিকল্পনা, রাষ্ট্রের দুর্বৃত্তায়ন, সিটি করপোরেশনের জবাবদিহি ও ব্যবসায়ীদের নিরাপত্তা নিয়েও তিনি বক্তব্য দেন। তিনি জানান, দেড় বছরে নারায়ণগঞ্জে ১৪২টি ঘটনায় ব্যবসা পরিচালনায় বাধা সৃষ্টি হয়েছে।
বিএফইউজের দপ্তর সম্পাদক আবু বক্কর বলেন, ফ্যাসিস্ট আমলে এমন মুক্ত পরিবেশে কথা বলার সুযোগ ছিল না। তিনি জুলাই যোদ্ধা ও আহত নিহতদের স্মরণ করেন এবং জুলাই সনদ বাস্তবায়নের দাবি জানান। তিনি বলেন, নিরপেক্ষ তথ্য উপস্থাপন না করাই ফ্যাসিবাদের উত্থানের অন্যতম কারণ।
তিনি প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের অতীত ভূমিকা নিয়ে সমালোচনা করে বলেন, অতীতে দিগন্ত টেলিভিশন, ইসলামী টিভি, চ্যানেল ওয়ান, নয়া দিগন্ত ও আমার দেশ পত্রিকার ওপর হামলা হলে তারা নীরব ছিল। নয়া দিগন্তের সম্পাদক আসাদুল্লাহ খানের ওপর নির্যাতনের সময়ও কোনো প্রতিবাদ দেখা যায়নি।
শ্রম অধিদপ্তরের নারায়ণগঞ্জ শাখার উপ পরিচালক ইয়াসমিন আক্তার বলেন, একটি ইউনিয়নকে সচল রাখতে সাধারণ সভা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি অপসাংবাদিকতা পরিহারের আহ্বান জানিয়ে বলেন, সাংবাদিক ইউনিয়নের নিবন্ধন পাওয়া সহজ নয় এবং শ্রম অধিদপ্তর সবসময় সহযোগিতায় প্রস্তুত।
সভাপতির বক্তব্যে আবু সাউদ মাসুদ প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের ওপর হামলার নিন্দা জানালেও তাদের অতীত ভূমিকার কঠোর সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের ওপর হামলার সময় এসব গণমাধ্যম নীরব ছিল, এমনকি সংবাদও প্রকাশ করেনি। তিনি আবারও সতর্ক করে বলেন, সাংবাদিকদের ওপর হাত উঠলে সেই হাত ২৪ ঘন্টার মধ্যে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে। একই সঙ্গে সঠিক ও দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার আহ্বান জানান তিনি।
সভা শেষে ফ্লোর ওপেন করে সদস্যদের মতামত গ্রহণ করা হয়। বক্তারা ঐক্যবদ্ধভাবে সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষা, জনমত গঠন এবং নতুন বাংলাদেশ নির্মাণে সক্রিয় ভূমিকা রাখার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন। সভায় নারায়ণগঞ্জ সাংবাদিক ইউনিয়নের কার্যকরী কমিটির সদস্যসহ সকল সদস্য উপস্থিত ছিলেন।

