
ফাইল ছবি
বাংলাদেশে ইলেকট্রিক ট্রেন চালু করা হবে-এমন প্রতিশ্রুতি যুগ যুগের। কিন্তু বাস্তবায়নের মুখ দেখেনি এসব প্রতিশ্রুতি। তবে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার প্রকল্পটি দ্রুত এগিয়ে নিচ্ছে। আগামী দুই থেকে আড়াই বছরের মধ্যে ইলেকট্রিক ট্রেন চলবে বলে জানিয়েছেন রেলওয়ের মহাপরিচালক। শুরুতে নারায়ণগঞ্জ থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত চলবে। পরবর্তীতে নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকা হয়ে চট্টগ্রাম পর্যন্ত চলবে এই দ্রুতগামী ট্রেন। এই ট্রেন হবে অনেক দ্রুতগামী, ব্যয় সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব।
পতিত আওয়ামী লীগ সরকার গত ১৫ বছরে রেলে প্রায় ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকার উন্নয়নের কথা বললেও এসব উন্নয়ন ঘিরে কোটি কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে। বারবার বলা হয়েছিল-উচ্চগতির বুলেট ট্রেনসহ ইলেকট্রিক ট্রেন চালু করা হবে। কিন্তু সব প্রতিশ্রুতিই ভাঁওতায় পরিণত হয়েছে। বুলেট ট্রেন দূরের কথা, ইলেকট্রিক ট্রেন চালু করতে একটি স্বচ্ছ সমীক্ষাও করেনি আওয়ামী সরকার। বরং, বুলেট-ইলেকট্রিক ট্রেন চালুর গল্প শুনিয়ে রেলে লুটতরাজ হয়েছে। তবে গত বছরের ৫ আগস্টের পর অন্তর্বর্তী সরকারের রেলওয়ে উপদেষ্টাসহ সংশ্লিষ্টরা ইলেকট্রিক ট্রেন চালাতে পরিকল্পনা অনুযায়ী দ্রুততার সঙ্গে কাজ করছেন। নারায়ণগঞ্জ দেশের অন্যতম প্রধান শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্য কেন্দ্র। চট্টগ্রামের প্রধান সমুদ্র বন্দরের মাধ্যমে বাংলাদেশের ৯০ শতাংশ আমদানি-রপ্তানি হয়। ইলেকট্রিক ট্রেন চালু হলে এ পথে পণ্য পরিবহন ব্যাপক বাড়বে।
এ প্রসঙ্গে রোববার বিকালে রেলপথ উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান যুগান্তরকে বলেন, রেলে স্থায়ী উন্নয়ন জরুরি। আধুনিকতার সঙ্গে মিল রেখে সুদূরপ্রসারী উন্নয়নের বিকল্প নেই। লুটপাটের উন্নয়নে বুলেট ও ইলেকট্রিক ট্রেনের স্বপ্ন দেখানো হয়েছিল। আমরা সুদূরপ্রসারী উন্নয়নের লক্ষ্যে ইলেকট্রিক ট্রেন চালু করতে যাচ্ছি। বৈদ্যুতিক সংযুক্তির মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব রেলপথ তৈরি ও ট্রেন চালানোর মধ্য দিয়ে সর্বোচ্চ সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। দ্রুতগতির ট্রেন চালানোর পাশাপাশি বর্তমান ট্রেন পরিচালনায় যে ব্যয় হচ্ছে-তার প্রায় অর্ধেক ব্যয়ে ইলেকট্রিক ট্রেন পরিচালনা সম্ভব হবে। এতে আয় বাড়ার সঙ্গে যাত্রীদের সেবা ও নিরাপত্তাও নিশ্চিত হবে। বিশ্বে ইলেকট্রিক ট্রেন চলছে-বাংলাদেশেও চলবে। রেলওয়ের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মো. আফজাল হোসেন বলেন, ইলেকট্রিক ট্রেন বিশ্বে (যেসব দেশে রেলপথ রয়েছে) চলাচল করছে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার রেলের সার্বিক উন্নয়নের সঙ্গে ইলেকট্রিক ট্রেন চালুর বিষয়ে জোর দিয়েছে। নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকা হয়ে চট্টগ্রাম পর্যন্ত এবং টঙ্গী থেকে জয়দেবপুর অংশে এ প্রকল্পের সমীক্ষার কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। আমরা শুরুতে নারায়ণগঞ্জ থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত প্রায় ১৬টি ইলেকট্রিক ট্রেন পরিচালনা করব। আশা করছি দুই-আড়াই বছরের মধ্যে ইলেকট্রিক ট্রেন পরিচালনা করতে পারব। এ পথে তথা দেশে ইলেকট্রিক ট্রেনের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। সাধারণ যাত্রীরা দ্রুত সময়ে ট্রেন ভ্রমণ করতে চায়। দ্রুত ট্রেন পরিচালনার ক্ষেত্রে ইলেকট্রিক ট্রেন ছাড়া বিকল্প নেই।
রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ঢাকা-টঙ্গী-জয়দেবপুর পর্যন্ত ২য় ও ৩য় লাইন স্থাপন প্রকল্পটি প্রায় ১৩ বছর ধরে চলমান রয়েছে। এ প্রকল্পটি ৩ বছরের মধ্যে সমাপ্ত হওয়ার কথা থাকলেও ব্যয় ও সময় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩ বছরের বেশি। প্রতিশ্রুতি ছিল, এ প্রকল্প চালুর মধ্য দিয়ে ঢাকা থেকে ৫-৬ মিনিট পর পর ট্রেন চালানো হবে। রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, এ পথে ইলেকট্রিক ট্রেন চালু হলে ব্যাপক সাড়া ফেলবে। রাজধানীর আশপাশের জেলাগুলো থেকে চাকরিজীবী, ব্যবসায়ীসহ সাধারণ যাত্রীরা অল্প সময়ের মধ্যে রাজধানীতে যাতায়াত করতে পারবে।
‘বাংলাদেশ রেলওয়ের নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকা হয়ে চট্টগ্রাম পর্যন্ত ইলেকট্রিক ট্র্যাকশন (ওভারহেড ক্যাটেনারি ও সাব-স্টেশন নির্মাণসহ)’ নামে প্রকল্পটি ২০২১ সালের ২১ অক্টোবর অনুমোদিত হয়। দুই দফা মেয়াদ বাড়িয়ে জুন ২০২৫ নাগাদ প্রকল্পের কাজ শতভাগ সম্পন্ন করার সিদ্ধান্ত ছিল। আগামী ৩ মাসের মধ্যে সমীক্ষা সমাপ্ত হবে বলে জানানো হয়েছে।
জানা যায়, নারায়ণগঞ্জ থেকে কমলাপুর হয়ে চট্টগ্রাম পর্যন্ত বিদ্যমান রেলপথটির দৈর্ঘ্য প্রায় ৩৩৭ কিলোমিটার। এর সঙ্গে টঙ্গী-জয়দেবপুর সেকশনের আরও প্রায় ১১ কিলোমিটার রেলপথ বিদ্যুৎচালিত ট্রেন চলাচলের উপযোগী করে গড়ে তোলার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ চলছে। সমীক্ষা প্রকল্পটি সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নে ১৫ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে অনুমোদিত হয়। প্রকল্পটি প্রথম সংশোধনীতে ব্যয় ও সময় এক বছর বাড়িয়ে এপ্রিল ২০২৪ পর্যন্ত করা হয়। দ্বিতীয় দফায় মেয়াদ ও ব্যয় বাড়িয়ে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাড়ার কারণে অতিরিক্ত জিওবি অর্থের সংস্থান এবং চলমান প্রকল্পের কার্যপরিধিতে ধীরাশ্রম-পূবাইল ও ফৌজদারহাট-সিজিপিওয়াই সেকশন অন্তর্ভুক্ত করায় প্রকল্পটির দ্বিতীয় সংশোধিত পিএফএস (প্রজেক্ট প্রপোজাল ফর ফিজিবিলিটি স্টাডি) প্রণয়ন করা হয়েছে।
প্রকল্প সংশোধনের যৌক্তিকতা প্রসঙ্গে প্রকল্প পরিচালক ও বাংলাদেশ রেলওয়ের বৈদ্যুতিক প্রকৌশলী (পশ্চিম) মো. হাবিবুর রহমান জানান, অনুমোদিত প্রকল্পটির কার্যপরিধি হিসাবে নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকা হয়ে চট্টগ্রামে বিদ্যমান রেলপথে বৈদ্যুতিক ট্রেন পরিচালনার জন্য সম্ভাব্যতা সমীক্ষা এবং টঙ্গী থেকে ড্রয়িং ও ডিজাইনের জন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে। এটি বাস্তবায়ন হলে ইলেকট্রিক লোকোমোটিভের মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে রেলওয়েতে কনটেইনার পরিবহন উল্লেখযোগ্য হারে বাড়বে।
রেলওয়ের বক্তব্য, আধুনিক এই জমানায় ডিজেল ইঞ্জিন নেহাতই বোকামি। প্রায় ৭৭ শতাংশ মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিন দিয়ে ট্রেন চালানো হচ্ছে। এসব ইঞ্জিনের যন্ত্রাংশও পাওয়া যাচ্ছে না। বাংলাদেশে চলা অধিকাংশ ইঞ্জিন বিশ্বের অন্য কোনো দেশে চলে না। এসব ইঞ্জিন বহু বছর আগেই বাতিল করা হয়েছে। ইলেকট্রিক ইঞ্জিনের পক্ষে বাংলাদেশ রেলওয়ে। পরিবেশ দূষণ কমানোর পাশাপাশি ডিজেল খাতে খরচ কমাতে ইলেকট্রিক ট্রেনের বিকল্প নেই। বর্তমানে ডিজেল ইঞ্জিনপ্রতি রেলের খরচ হয় ২৫-২৮ কোটি টাকা। এছাড়া ইলেকট্রিক ইঞ্জিন ডিজেল ইঞ্জিনের অর্ধেকের কম খরচে কেনা যায়।