
ফাইল ছবি
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলায় টানা বর্ষণে জলাবদ্ধতা, প্রচন্ড গরম ও লোডশেডিংয়ের কারণে শিল্প কলকারখানার শ্রমিক ও আবাসিক এলাকায় জনজীবনও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। এ উপজেলায় ছোট-বড় প্রায় আড়াই হাজার শিল্প-কারখানা রয়েছে। কয়েক দিন ধরে ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে এসব কারখানার উৎপাদন চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এতে লোকসানের মুখে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা।
শিল্প-কারখানার মালিক ও ব্যবসায়ীরা জানান, কয়েকদিনের ঘন ঘন লোডশেডিং এর কারনে জেনারেটরের মাধ্যমে কারখানা সচল রাখতে গিয়ে অতিরিক্ত খরচ হচ্ছে তাদের। কিন্তু তাতেও শতভাগ উৎপাদন করতে পারছেন না। তারা বলছেন, এভাবে লোডশেডিং চলতে থাকলে শিল্প-কারখানাগুলো সচল রাখাই কঠিন হয়ে পড়বে। এছাড়া উৎপাদন কমে আসলে শ্রমিক কর্মচারীদের বেতন ভাতাও কমে আসবে শঙ্কায় রয়েছেন শ্রমিক কর্মচারীরা। শিল্প কারখানার উৎপাদন শতভাগ রাখতে শতভাগ বিদ্যুতের বিকল্প নেই।
জানা গেছে, রূপগঞ্জ উপজেলার দাউদপুর, যাত্রামুড়া, বরাব, বরপা, তারাবো, রুপসী, মৈকলী, ভুলতা, আড়িয়াবো, কর্ণগোপ, গোলাকান্দাইল, মুড়াপাড়া, কাঞ্চন, হাটাবো, সাওঘাট, কাতরারচক, ডহরগাঁও, পাড়াগাঁও, মুড়াপাড়া, বানিয়াদি, কলিঙ্গা, কায়েতপাড়াসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় প্রায় আড়াই হাজার শিল্প-কারখানা রয়েছে। এসব কারখানায় উৎপাদন হচ্ছে প্যান্ট, শার্ট, গেঞ্জি, থ্রিপিস, চাদর, প্রিন্ট কাপড়, লুঙ্গি, প্লাস্টিক জাতীয় পণ্যসহ হরেকরকমের জিনিসপত্র। রয়েছে নিটিং ডাইং অ্যান্ড ফিনিশিং কারখানাও।
এর মধ্যে হারবেস্ট রিচ গার্মেন্টস, অলটেক্স, অন্তিম নিটিং ডাইং অ্যান্ড ফিনিশিং কারখানা, গ্রামটেক নিট ডাইং অ্যান্ড ফিনিশিং কারখানা, ফকির ফ্যাশন, সিটি অয়েল মিল, প্রাণ-আরএফএল কোম্পানি, ম্যাক্স সুয়েটার, রবিন টেক্স অ্যান্ড গার্মেন্টস লিমিটেডের মতো বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানও জেনারেটর চালিয়ে কারখানা সচল রাখতে হিমশিম খাচ্ছে। কারণ লোডশেডিংয়ের পাশাপাশি এলাকায় গ্যাসেরও সংকট রয়েছে। তাছাড়া এভাবে সংকট মোকাবিলা করতে গিয়ে কারখানাগুলোয় উৎপাদন ব্যয় অনেক বেড়ে যাচ্ছে।
আবাসিক এলাকার বাসিন্দারা জানান, রূপগঞ্জ উপজেলার প্রত্যেকটি এলাকায় ঘনবসতিপূর্ণ। লাখ লাখ মানুষের বসবাস। প্রচন্ড গরম ও লোডশেডিংয়ে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১৮ ঘণ্টাই বিদ্যুৎ থাকছে না। তীব্র গরমে অতিষ্ঠ মানুষ। বিশেষ করে শিশু, বৃদ্ধ ও অসুস্থ লোকজনের কষ্টের সীমা নেই। টানা কয়েকদিনের বৃষ্টিতে নারায়ণগঞ্জ নরসিংদী অগ্রণী সেচ প্রকল্প ও উত্তর রুপগঞ্জ পানি সংরক্ষণ প্রকল্প এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়ে কৃত্রিম বন্যায় পরিণত হয়েছে। এসব এলাকার পানি সেচের জন্য এই দুটি প্রকল্প ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু কয়েকদিনের ঘন ঘন লোডশেডিং এর কারনে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হওয়া পানি সেচ পাম্প ব্যবহার করে নিষ্কাশন করতে পারছেন না। ফলে জলবদ্ধ স্থায়ী রূপ ধারণ করেছে। এতে করে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন জনগণ। লোডশেডিং এর কারনে খাবার পানিরও সংকট দেখা দিয়েছে।
কাতরারচক এলাকার গ্রামটেক নিট ডাইং অ্যান্ড ফিনিশিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের সিনিয়র ম্যানেজার আইয়ুব হোসেন বলেন, লোডশিংয়ের কারণে কারখানা সচল রাখতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। গ্যাস দিয়েও বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছি না। কারণ গ্যাসের প্রেসার একদম কম।
গোলাকান্দাইল ইউনিয়নের আমলাব এলাকার এলাকার জুনায়েত ফ্যাশন গার্মেন্টসের ম্যানেজার সাখাওয়াত হোসেন বলেন, আমার কারখানায় টি-শার্ট তৈরি হয়। কারখানাটি বিদ্যুতের ওপর নির্ভরশীল। দিনে অন্তত ১৫ থেকে ২০ বার বিদ্যুৎ চলে যায়। কারখানায় নিয়োজিত প্রায় শতাধিক’ শ্রমিক বিদ্যুৎ না থাকলে বসে সময় কাটান।
কাঞ্চন এলাকার বিএম টেক্সটাইল লিমিটেড নামে চাদর উৎপাদন কারখানার মালিক হাজী খলিল সিকদার বলেন, কাঞ্চনে প্রায় ৩৫টির মতো চাদর তৈরির কারখানা আছে। প্রচন্ড গরম ও লোডশেডিংয়ের কারণে চাদরের উৎপাদন অর্ধেকের চেয়ে বেশি নেমে এসেছে। শ্রমিকরা কাজ না করে অলস সময় পার করছেন। এভাবে চলতে গেলে শ্রমিক কর্মচারী এবং মালিকদের খেয়ে না খেয়ে দিন কাপটাতে হবে।
ভুলতা এলাকার ভাই ভাই এমব্রয়ডারি কারখানার মালিক আলিনুর ব্যাপারী বলেন, একদিকে প্রচন্ড গরম অন্যদিকে ঘন ঘন লোডশেডিং। আমরা আর কুলিয়ে উঠতে পারছি না। সরকারের কাছে এই সমস্যা সমাধানের জন্য জোর দাবি জানান এই ব্যবসায়ী।
বরপা এলাকার অন্তিম নিটিং ডাইং অ্যান্ড ফিনিশিং কারখানার দায়িত্বরত একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, বিদ্যুৎ সংকটের কারণে গ্যাসের মাধ্যমে জেনারেটর চালিয়ে উৎপাদন অব্যাহত রাখা হয়েছে। তবে গ্যাস সংকটের কারণে প্রায়ই ডিজেল ব্যবহার করতে হচ্ছে। লোকসানের মুখে পড়ায় গ্যাস বিল পরিশোধ করতে হিমশিম খেতে হয় । তারপরও শ্রমিকদের কথা চিন্তা করে মালিকপক্ষ অনেক কষ্টে কারখানা চালু রেখেছেন।
গাউছিয়া মার্কেটের ফ্যাশন টাচ নামের কাপড় ব্যবসায়ী মোক্তার হোসেন বলেন, কয়েকদিনের ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারনে ক্রেতা কমে গেছে। অতিরিক্ত গরমে হাঁপিয়ে উঠেছে ব্যবসায়ীরা। জেনারেটর চালিয়ে লোকসান গুনতে হচ্ছে অনেকের।
মধুখালী এলাকার সমাজসেবক মাহাবুব আলম প্রিয় বলেন, লোডশেডিংয়ের কারণে এই গরমে সবচেয়ে বেশি সমস্যা হচ্ছে শিশুদের। শিশুরা পর্যাপ্ত ঘুমাতে পারছে না লোডশেডিং এর কারণে। নিম্ন আয়ের মানুষের সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি। যাদের বিকল্প হিসেবে আইপিএস রয়েছে ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে সেটাও ব্যবহার করতে পারছে না। আইপিএস এর ব্যাটারিগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
কাঞ্চন এলাকার শাহেল মাহমুদ বলেন, ঘনঘন এবং অতিরিক্ত লোডশেডিং এর কারনে পানি সংকট দেখা দিয়েছে। হাট বাজার থেকে পানি কিনে খেতে হচ্ছে। ব্যাটারি চালিত অটো রিক্সা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ভোগান্তিতে পড়েছেন স্থানীয়রা। বেরিবাধ এলাকায় পানি নিষ্কাশন করতে পারছে না । ফলে জলবদ্ধতা থেকেই যাচ্ছে।
ইকরা কিন্ডার গার্ডেন্স স্কুলের প্রধান শিক্ষক শফিকুল ইসলাম বলেন, লোডশেডিং এর কারনে বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা অতি কষ্টের ক্লাস করছে। অতিরিক্ত টাকা খরচ হলেও শিক্ষার্থীদের জন্য জেনারেটরের ব্যবস্থা করেছি। তবে সবগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জেনারেটরের ব্যবস্থা জরুরি বলে মনে করছি।
উত্তর রূপগঞ্জ পানি সংরক্ষণ ও সেচ প্রকল্পের প্রকৌশলী সাদিকুর রহমান বলেন, টানা বৃষ্টিতে যে পরিমাণ পানি জমেছে সে পরিমাণ সেচের ব্যবস্থা এখানে নেই। এছাড়া সবচেয়ে বড় কথা হল বিদ্যুতের সমস্যা। ঘনঘন লোডশেডিংয়ের কারনে স্বেচ্ছাম সচল রেখে পানি টানতে পারছি না। তবে বিদ্যুতের সমস্যা সমাধান হলে দ্রুত আমরা জলবদ্ধতা নিরসন সমাপ্ত করতে পারব বলে আশা করছি।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাক্তার আইভী ফেরদৌস বলেন, এই গরমে সকলকে বেশি করে বিশুদ্ধ পানি পান করতে হবে। এছাড়া জলাভূততার কারণে নানা ধরনের পানি বাহিত রোগের আশঙ্কা রয়েছে। গরমে নানা ধরনের রোগ দেখা দিতে পারে। সমস্যা হলে অবশ্যই চিকিৎসকদের পরামর্শ নিতে হবে।
নারায়ণগঞ্জ পল্লী বিদ্যুৎ ২ এর জিএম প্রকৌশলী নূর মোহাম্মদ বলেন, গত ৫ দিন আগে ভূলতা গ্রীড উপকেন্দ্রে সকালে একবার এবং দুপুরে একবার ফ্লাশিং হওয়ার কারনে জি টি --১ এবং জি টি -২ দুইটি ট্রান্সফরমার বন্ধ হয়ে যায়। ট্রান্সফরমার ২ টি চালু করার কাজ করতে সময় লেগেছে। যার ফলে রুপগঞ্জ, আড়াইহাজার ও মাধবদী উপজেলায় এই সমস্যার কারনে বিদ্যুৎ বন্ধ ছিলো। কাজটি খুবই জটিল বিধায় সমাধানে সময় লেগেছে। তবে, বর্তমানে জাতীয় গ্রীডে সমস্যা থাকায় লোডশেডিং দিতে হচ্ছে। আশা করছি অতি দ্রুত সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
রূপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার সাইফুল ইসলাম বলেন, বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের কারণে জনজীবনে ভোগান্তি এবং লোকসান হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। লোডশেডিং এর ব্যাপারে পল্লী বিদ্যুৎ অফিসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা হয়েছে। তারা জানিয়েছে আগামী ২/৩ দিনের মধ্যে সমাধান হয়ে যাবে।