প্রতীকী ছবি
আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে গত ৩ নভেম্বর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) জাতীয় সংসদের মোট ৩০০ আসনের মধ্যে ২৩৭টিতে দলীয় প্রার্থীর সম্ভাব্য একটি তালিকা প্রকাশ করে। কিন্তু ওই তালিকায় নাম নেই দলটির অনেক হেভিওয়েট ও আলোচিত নেতার। এর মধ্যে রয়েছেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু, আসলাম চৌধুরী, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল ও অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন ফারুক, আব্দুস সালাম, যুগ্ম মহাসচিব হাবিব উন নবী খান সোহেল, হুমায়ুন কবির, সাবেক সংসদ সদস্য রুমিন ফারহানা, প্রচার সম্পাদক সুলতান সালাহউদ্দিন টুকু, সিলেটের সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী, মহিলা দলের সভানেত্রী আফরোজা আব্বাস ও মুন্সিগঞ্জ জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি আব্দুল হাই।
এরই মধ্যে গুঞ্জন উঠেছে দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব ওই মনোনয়ন তালিকার অন্তত ২৩টিতে পরিবর্তন বা সংশোধন আনবে। ইতোমধ্যে দলটির নেতাকর্মীদের মধ্যে কথা উঠেছে, যারা এখনও মনোনয়ন পাননি তারা শেষ মুহূর্তের বিচারে মনোনয়ন পেলে নির্বাচনী প্রস্তুতি নিতে অনেক বেগ পেতে হবে। একদিকে যারা মনোনয়ন পেয়ে মাঠে আছেন তাদেরকে কিভাবে ম্যানেজ করা হবে; অন্যদিকে যারা পুনর্বিবেচনায় মনোনয়ন পাবেন তারা মাঠ কিভাবে সামলাবেন? এর সার্বিক প্রভাব পড়তে পারে ভোটের ফলাফলে।
বিএনপি প্রার্থী তালিকা প্রকাশের পর বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা গণমাধ্যমে বলেছেন, অনেক আসনে মনোনয়ন নিয়ে নেতা-কর্মীদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু সাংগঠনিক শাস্তির ভয়ে মনোনয়নবঞ্চিত নেতারা প্রকাশ্যে কঠোর কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখালেও ভেতরে ভেতরে ক্ষোভ-দুঃখে ফুঁসছেন। ইতোমধ্যে বিএনপির মনোনয়ন নিয়ে ক্ষোভ থেকে অন্তত সাত জেলায় বিক্ষোভ মিছিল, প্রতিবাদ সমাবেশ, সড়ক-রেলপথ অবরোধ ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। ওই জেলাগুলোর মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রাম, মাদারীপুর, মেহেরপুর, সাতক্ষীরা, চাঁদপুর, ময়মনসিংহ, নাটোর ও নওগাঁ। এর মধ্যে কয়েকটি জেলায় প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষগুলোর মধ্যে সংঘর্ষ ও আহত হওয়ার ঘটনাও রয়েছে।
দলের সিনিয়র নেতারা মনোনয়ন নিয়ে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, তরুণদের বেশির ভাগকে প্রার্থী হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে বিগত আন্দোলনে তাদের ভূমিকা দেখে। এই তরুণ প্রার্থীর তালিকায় নতুনদের অনেকের পারিবারিক রাজনৈতিক ইতিহাস রয়েছে। তবে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে বিএনপির অনেক সিনিয়র নেতার পরিবারের সদস্যদের মনোনয়ন না পাওয়া নিয়েও। দলটির সিনিয়র নেতাদের সন্তান, ভাই এবং কারো কারো স্ত্রী মনোনয়ন প্রত্যাশী। ঠাকুরগাঁও-২ আসনে মির্জা ফখরুল ইসলামের ভাই, সিরাজগঞ্জ-১ আসনে স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুর স্ত্রী, টাঙ্গাইল-৫ আসনে আবদুস সালাম পিন্টুর ভাই, ঢাকা-৯ আসনে স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের স্ত্রী, কুমিল্লা-২ আসনে স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের ছেলে, চট্টগ্রাম-১১ আসনে আমীর খসরু মাহমুদের ছেলে, কক্সবাজার-২ আসনে স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদের স্ত্রী মনোনয়ন প্রত্যাশী।
দলের সিনিয়র নেতারা জানিয়েছেন, এক পরিবারে একজনের বেশি মনোনয়ন পাবেন না-বিএনপি এমন নীতিতে বিশ্বাসী বলে এসব আসনে পরিবারের সদস্যদের প্রার্থী করা হয়নি। যদিও উল্লেখিত আসনগুলোতে মনোনয়নের দৌড়ে সক্রিয় রয়েছেন অন্য নেতারা। এতে করে একদিকে যেমন দ্বন্দ্ব তৈরি হচ্ছে, তেমনি অন্যদিকে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে তৃণমূলের কর্মীদের মাঝেও।
জানা গেছে, এসব বিবেচনায় প্রার্থী তালিকায় পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে বিএনপি। তৃণমূলের মতামতের ভিত্তিতে অন্তত ২৩টি আসনে এ পরিবর্তন আনা হচ্ছে। অপরদিকে, শরিক দলগুলোর জন্য ২০টি আসনে ছাড় দিচ্ছে বিএনপি। মনোনয়নের বিষয়ে বিএনপির সিনিয়র নেতাদের পরিবারের আটটি আসন নিয়েও চলছে অনিশ্চয়তা। তবে এ মাসের মধ্যেই চূড়ান্ত করা হচ্ছে ৩০০ আসনের প্রার্থী তালিকা।
দলের নীতিনির্ধারণী মহলের সাথে যোগাযোগ করে এসব তথ্য জানা গেছে। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে গত ৩ নভেম্বর বিএনপি সারাদেশের ৩০০ আসনের মধ্যে ২৩৭টি আসনের প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করে। এর মধ্যে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার জন্য দিনাজপুর, বগুড়া ও ফেনীতে তিনটি এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের জন্য বগুড়ায় একটি আসন রয়েছে।
দলের স্থায়ী কমিটির অনুমোদন সাপেক্ষে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এ প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করা হয়।
সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এর মধ্যে ৮৩ জন প্রার্থী একেবারেই নতুন। এর আগে তারা সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেননি। তবে এদের মধ্যে অন্তত ১০ জন রয়েছেন, যাদের বাবা এর আগে সংসদ সদস্য ছিলেন। এ ছাড়া দুইজনের স্বামী এমপি কিংবা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ছিলেন। বিএনপির প্রার্থী তালিকায় চার জন ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু আছেন। রয়েছেন ১২টি আসনে ১০ জন নারী প্রার্থীও। যদিও প্রার্থী ঘোষণার পরদিনই মাদারীপুর-১ আসনের কামাল জামান মোল্লার নাম ঘোষণা হলেও তা স্থগিত করে বিএনপি।
শরিক দলগুলোর মধ্যে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বগুড়া-২, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৫, জাতীয় জোটের নেতা সৈয়দ এহসানুল হুদা কিশোরগঞ্জ-৫, এলডিপির চেয়ারম্যান অলি আহমেদের ছেলে অধ্যাপক ওমর ফারুক চট্টগ্রাম-১৪, দলটির মহাসচিব রেদওয়ান আহমেদ কুমিল্লা-৭, জাতীয় পার্টি (জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার পিরোজপুর-১, জেএসডি সভাপতি আ. স. ম. আবদুর রবের স্ত্রী তানিয়া রব লক্ষ্মীপুর-৪, বাংলাদেশ এলডিপির মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম লক্ষ্মীপুর-১, বিজেপি চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ ঢাকা-১৭, এনডিএম চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ ঢাকা-১৩, গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর পটুয়াখালী-৩, দলটির মহাসচিব রাশেদ খান ঝিনাইদহ-২, এনপিপি চেয়ারম্যান ফরিদুজ্জামান ফরহাদ নড়াইল-২, লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মুস্তাফিজুর রহমান ইরান ঝালকাঠি-১, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের একাংশের জুনায়েদ আল হাবিব ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ এবং গণফোরাম ও গণঅধিকারের রাজনীতির পর এখন কোনো দলে না থাকা রেজা কিবরিয়া হবিগঞ্জ-১ আসনে প্রার্থী হচ্ছেন। এসব আসনগুলোতে কারো নাম ঘোষণা করেনি বিএনপি।
জানা গেছে, উল্লেখিত আসনগুলো যে জোটের প্রার্থীরা মনোনয়ন পাবেন, তা অনেকটাই নিশ্চিত।
এ বিষয়ে গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, জোট নয়, যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলগুলোর সাথে আসন সমঝোতার ব্যাপারে বিএনপির দুই দফা ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। অনানুষ্ঠানিক আলোচনা এখনো চলমান আছে, এ মাসের মধ্যেই আবারো বৈঠকের মাধ্যমে আসন সমঝোতার বিষয়টি চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করা হবে।

