রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪

|

বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

Advertisement
Narayanganj Post :: নারায়ণগঞ্জ পোস্ট

রমজানে মসজিদ প্রাণবন্ত করার অনুশীলন

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

প্রকাশিত: ১২:৩০, ১৩ এপ্রিল ২০২৩

রমজানে মসজিদ প্রাণবন্ত করার অনুশীলন

সংগৃহীত

পবিত্র রমজান মুমিনের ইবাদত ও আনুগত্যের অনুশীলন করার মাস। রমজানে মুমিন সংযম, নেক আলম ও পাপ পরিহারের অনুশীলন করে। রমজানে শেষ দশকে ইসলাম মুমিনদের মসজিদ আবাদের অনুশীলন করতে বলেছে। আর মুমিন তা করে ইতিকাফ ও মসজিদে ইবাদতমগ্ন অবস্থায় দীর্ঘ সময় কাটিয়ে। এই অনুশীলনের লক্ষ্য হলো মসজিদের সঙ্গে দূরত্ব কমানো, হৃদ্যতা বৃদ্ধি করা এবং মসজিদভিত্তিক সমাজবিনির্মাণের পথ সুগম করা।

মসজিদ আবাদ করার ব্যাখ্যা : ‘মসজিদ আবাদ করা’ বাক্যটি তাৎপর্যপূর্ণ ও ব্যাপকার্থক। কেননা মসজিদ নির্মাণ, তা সংরক্ষণ, তাকে ইবাদতের উপযোগী করে রাখা এবং তাতে ইবাদতের ধারা অব্যাহত রাখা সব কিছুই মসজিদ আবাদ করার অন্তর্ভুক্ত। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তারাই তো আল্লাহর মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণ করবে, যারা ঈমান আনে আল্লাহ ও আখিরাতে এবং নামাজ কায়েম করে, জাকাত দেয় এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো ভয় করে না।’ (সুরা তাওবা, আয়াত :  ১৮)

বিপরীতে তারাই মসজিদ বিরানকারী বলে গণ্য হবে, যারা তাকে জনশূন্য করতে চায়, যারা তাতে ভয়ের পরিবেশ তৈরি করতে চায়। ইরশাদ হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর মসজিদগুলোতে তাঁর নাম স্মরণ করতে বাধা প্রদান করে এবং তাদের বিনাশ সাধনে প্রয়াসী হয় তার চেয়ে বড় অবিচারকারী কে হতে পারে? অথচ ভয়-বিহ্বল না হয়ে তাদের জন্য মসজিদে প্রবেশ করা সংগত ছিল না।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১১৪)

কোরআনের ভাষায় মসজিদ আবাদ : পবিত্র কোরআনের নিম্নোক্ত আয়াতে আল্লাহ মসজিদ আবাদকারীদের প্রশংসা করেছেন। যাতে সাহাবায়ে কেরামের যুগের একটি জীবন্ত মসজিদের দৃশ্য চিত্রিত হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘সেসব ঘরে যাকে সমুন্নত করতে এবং যাতে তাঁর নাম স্মরণ করতে আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন, যারা (তাতে) সকাল ও সন্ধ্যায় তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে, সেসব লোক যাদের ব্যবসা-বাণিজ্য এবং ক্রয়-বিক্রয় আল্লাহর স্মরণ থেকে এবং নামাজ কায়েম ও জাকাত প্রদান থেকে বিরত রাখে না, তারা ভয় করে সেদিনকে যেদিন অনেক অন্তর ও দৃষ্টি বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে।’ (সুরা নুর, আয়াত : ৩৬-৩৭)

উল্লিখিত আয়াতদ্বয়ে মসজিদ আবাদের অর্থে যেসব বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে তা হলো, আল্লাহর ঘর সমুন্নত করা, সকাল-সন্ধ্যা আল্লাহর ইবাদত ও জিকির করা, মসজিদের প্রতি পূর্ণ মনোযোগ থাকা, নামাজ দেওয়া, জাকাত আদায় করা ও অন্তরে আল্লাহর ভয় রাখা।

হাদিসের আলোকে মসজিদ আবাদ : হাদিসের এক বর্ণনায় মসজিদ আবাদের আরো বিস্তৃত অর্থ পাওয়া যায়। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেন, যখন কোনো সম্প্রদায় আল্লাহর কোনো ঘরে সমবেত হয়ে আল্লাহর কিতাব তিলাওয়াত করে এবং পরস্পরে তা নিয়ে আলোচনা করে, তখন তাদের ওপর শান্তি বর্ষিত হয়, তাদের রহমতে ঢেকে নেয়, ফেরেশতারা তাদের ঘিরে রাখে এবং আল্লাহ তাঁর নিকটবর্তী ফেরেশতাদের কাছে তাদের প্রশংসা করেন।’ (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ১৪৫৫)

অর্থাৎ দ্বিনি কাজের মাধ্যমে মসজিদ সজীব রাখাই মসজিদ আবাদের মূল উদ্দেশ্য।

মসজিদ আবাদের অনুশীলন

রমজানে মুসলিম উম্মাহ একক ও সম্মিলিত ইবাদতের মাধ্যমে মসজিদ আবাদ করার অনুশীলন করে থাকে। নিম্নে এমন কিছু কাজের বিবরণ দেওয়া হলো।

১. ইতিকাফ : ইতিকাফ রমজানে মসজিদ আবাদ করার সবচেয়ে বড় অনুশীলন। রমজানের শেষ দশকে মহানবী (সা.) নিয়মিত ইতিকাফ করতেন। রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ করা সুন্নতে কেফায়া। অর্থাৎ প্রত্যেক মহল্লার একদল মানুষের জন্য ইতিকাফ করা আবশ্যক। দীর্ঘ ১০ দিন মসজিদে অবস্থানের ফলে একদিকে ব্যক্তির মন-মানসিকতা ও ঈমান-আমলে পরিবর্তন আসে, অন্যদিকে মুসল্লিদের সার্বক্ষণিক ইবাদত-বন্দেগিতে মসজিদ অনেক বেশি প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে।

২. মসজিদ নির্মাণ : যেকোনো সময়ই মসজিদ নির্মাণ করা যায়। তবে রমজানে যেহেতু যেকোনো আমলের সওয়াব বহু গুণ বৃদ্ধি পায়, তাই রমজানে মসজিদ নির্মাণের ঐতিহ্য ও চর্চা রয়েছে। যেমন বিশ্বের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় ‘আল-কারাউইন’-এর নির্মাণকাজ ২৪৫ হিজরি (মোতাবেক ৮৫৯ খ্রি.) রমজান মাসের প্রথম দিন শুরু করেন। মসজিদ হিসেবেই তার যাত্রা শুরু হয়েছিল।

৩. তারাবির জামাত : রমজানে মুসলিমরা সাধারণত তারাবির জামাতে অংশগ্রহণ করে এবং দীর্ঘ সময় মসজিদে অবস্থান করে। এতে মসজিদ ও মুসল্লিদের সঙ্গে হৃদ্যতা তৈরির সুযোগ হয়। আরব বিশ্বে তারাবির নামাজের সময় মসজিদে চা-কফির ব্যবস্থাও থাকে। যা পরিবেশকে আরো মধুর করে তোলে।

৪. সম্মিলিত ইফতার : মসজিদে সম্মিলিত ইফতার করা মুসলিম বিশ্বের অন্যতম প্রধান রমজান সংস্কৃতি। মসজিদুল হারাম ও মসজিদে নববী থেকে শুরু করে পৃথিবীর প্রায় সব মুসলিম অঞ্চলে সম্মিলিত ইফতারের চর্চা রয়েছে। সামাজিক ও ধর্মীয় মেলবন্ধন সৃষ্টি এবং মানুষকে মসজিদমুখী করার ক্ষেত্রে সম্মিলিত ইফতারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। কেননা ইফতারের দস্তরখানে সমাজের সর্বশ্রেণির মানুষ একসঙ্গে ইফতার গ্রহণ করে।

৫. কোরআন-হাদিস শিক্ষা : রমজান মুসলিম উম্মাহর ধর্মীয় জ্ঞানচর্চার অন্যতম উপলক্ষ। রমজানে মুসলিম বিশ্বের বেশির ভাগ অঞ্চলে; বিশেষত মধ্যপ্রাচ্য ও পশ্চিমা বিশ্বে মসজিদগুলোতে কোরআন-হাদিসের বিশেষ দরস বা শিক্ষা কার্যক্রম অনুষ্ঠিত হয়। সাধারণ মানুষ তাতে অংশগ্রহণ করে নিজেদের ধর্মীয় জ্ঞান সমৃদ্ধ করার সুযোগ পায়। অমুসলিম দেশে বসবাসকারী মুসলিমদের ধর্মীয় জ্ঞান আহরণের প্রধান সময়ই রমজান।

৬. আত্মশুদ্ধি ও আমলের প্রশিক্ষণ : ইতিকাফের পাশাপাশি রমজানে মুসলিম বিশ্বের পির-মাশায়েখদের দরবারে রমজানে আত্মশুদ্ধি ও আমলের বিশেষ প্রশিক্ষণ হয়ে থাকে। রমজানে সালেকিনরা (যারা আত্মশুদ্ধিতে আগ্রহী) নিজ নিজ পির ও শায়খের কাছে অবস্থান করে নিজের ঈমান-আমলের উন্নতি ও আধ্যাত্মিক উন্নয়নের জন্য চেষ্টা করে থাকে।

৭. মসজিদ পরিচ্ছন্ন করা : রমজান মাস আগমনের আগেই মসজিদ ও মসজিদের আঙিনা বিশেষভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয়। যেন মুসল্লিরা নির্বিঘ্নে ইবাদত করতে পারে। মক্কা ও মদিনার পবিত্র দুই মসজিদও রমজান উপলক্ষে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয়। বিশেষত শেষ দশকে ইতিকাফকারীদের আগমনের আগে।

৮. মসজিদ সাজসজ্জা করা : মসজিদের সাজসজ্জা মুসলিম বিশ্বের জনপ্রিয় রমজান-সংস্কৃতি। আরব ও তুর্কি মুসলিমরা বিপুল উৎসাহ-উদ্যমের সঙ্গে তা করে থাকে। দৃষ্টিনন্দন সাজসজ্জা মসজিদের প্রতি মুসল্লিদের আকর্ষণ বাড়িয়ে দেয়।

৯. কিয়ামুল লাইলের জামাত : রমজানে আরববিশ্বের প্রায় সব বড় মসজিদে কিয়ামুল লাইল বা তাহাজ্জুদের জামাত হয়। মুসল্লিরা দীর্ঘ সময় তাহাজ্জুদের নামাজে কোরআন তিলাওয়াত শ্রবণ করেন এবং আল্লাহর দরবারে তাঁরা বিনীত হয়ে প্রার্থনা করেন।

১০. মসজিদভিত্তিক সমাজসেবা কার্যক্রম : রমজান উপলক্ষে ভারতীয় উপমহাদেশসহ পশ্চিমা বিশ্বের মসজিদগুলো নানামুখী সামাজিক কার্যক্রম গ্রহণ করে। যেমন ইফতারসামগ্রী বিতরণ, জাকাতের অর্থ ব্যয়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, ঈদসামগ্রী বিতরণ, অসহায় মানুষকে মসজিদে আশ্রয় দান, ধর্মীয় সম্প্রীতিমূলক আলোচনা সভা ইত্যাদি।

আল্লাহ সমাজের মসজিদগুলোকে আবাদ করে দিন। আমিন