বুধবার, ২০ আগস্ট ২০২৫

|

ভাদ্র ৪ ১৪৩২

Advertisement
Narayanganj Post :: নারায়ণগঞ্জ পোস্ট

নারায়ণগঞ্জে উপজেলা পর্যায়ে ভয়াবহ লোডশেডিং

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

প্রকাশিত: ২১:০০, ২০ আগস্ট ২০২৫

নারায়ণগঞ্জে উপজেলা পর্যায়ে ভয়াবহ লোডশেডিং

ফাইল ছবি

নারায়ণগঞ্জের তিন উপজেলা আড়াইহাজার, রূপগঞ্জ ও সোনারগাঁ জুড়ে ভয়াবহ বিদ্যুৎ সংকট ও লোডশেডিং জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। কোথাও দিনে ৬ ঘণ্টাও বিদ্যুৎ থাকছে না, কোথাও আবার বিদ্যুৎ গেলে আর ফেরার নাম নেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা। ঘন ঘন বিদ্যুৎ আসা-যাওয়ার কারণে জনজীবন অচল হয়ে পড়েছে। বন্ধ হয়ে যাচ্ছে কলকারখানা, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ব্যবসা-বাণিজ্য। প্রচণ্ড গরমে হাঁসফাঁস করছে মানুষ, শিশু ও বৃদ্ধরা জ্বরে-রোগে ভুগছেন। পানির পাম্প বন্ধ হয়ে পানি সংকট দেখা দিয়েছে। প্রতিটি উপজেলাতেই একই চিত্র। বিদ্যুতের অস্থিতিশীলতায় জীবনের গতি থমকে গেছে।

রূপগঞ্জে ঘন ঘন লোডশেডিংয়ে শিল্পকারখানার উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। প্রায় আড়াই হাজার কারখানা রয়েছে এ উপজেলায়। হারবেস্ট রিচ গার্মেন্টস, অলটেক্স, অন্তিম নিটিং ডাইং, গ্রামটেক, ফকির ফ্যাশন, প্রাণ-আরএফএল, ম্যাক্স সুয়েটারসহ নামকরা কারখানাগুলোও বিদ্যুতের অভাবে হিমশিম খাচ্ছে। অনেক কারখানায় জেনারেটর চালিয়ে উৎপাদন সচল রাখার চেষ্টা চলছে, তবে গ্যাস সংকট ও ডিজেলের অতিরিক্ত ব্যয়ে লোকসান বাড়ছে। কারখানার মালিকরা বলছেন, এভাবে চলতে থাকলে উৎপাদন ব্যাহত হয়ে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা দিতেও হিমশিম খেতে হবে।

রূপগঞ্জে শুধু শিল্পই নয়, আবাসিক এলাকাও বিদ্যুৎ সংকটে ভুগছে। দিনরাত মিলে প্রায় ১৮ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে না। প্রচণ্ড গরমে লাখো মানুষ অতিষ্ঠ। ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে পানির পাম্প চলতে না পারায় কৃত্রিম জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। কৃষিজমির পানি নামছে না, বাসাবাড়িতেও দেখা দিয়েছে পানি সংকট। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্লাস নিতে সমস্যা হচ্ছে, ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, বাজারে ব্যবসায়ীরা লোকসান গুনছেন।

গোলাকান্দাইল ইউনিয়নের আমলাব এলাকার জুনায়েত ফ্যাশন গার্মেন্টসের ম্যানেজার সাখাওয়াত হোসেন বলেন, আমার কারখানায় টি-শার্ট তৈরি হয়। কারখানাটি বিদ্যুতের ওপর নির্ভরশীল। দিনে অন্তত ১৫ থেকে ২০ বার বিদ্যুৎ চলে যায়। কারখানায় নিয়োজিত প্রায় শতাধিক শ্রমিক বিদ্যুৎ না থাকলে বসে সময় কাটান।

অন্যদিকে আড়াইহাজারে পরিস্থিতি সবচেয়ে ভয়াবহ। ভুলতা গ্রিডের অর্ধেকের বেশি যন্ত্রপাতি বিকল হয়ে পড়ায় গত এক সপ্তাহ ধরে আড়াইহাজারে দিনে ৬ ঘণ্টাও বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে না। সারাদিনে কতবার যে বিদ্যুৎ আসা-যাওয়া করে তার ইয়াত্তা নেই। ৩০ মিনিট বিদ্যুৎ থাকলে ২-৩ ঘণ্টা থাকে না। শিল্পনির্ভর এ উপজেলায় কারখানাগুলোর উৎপাদন একেবারেই থমকে গেছে। কম্পিউটারসহ নানা ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, বিদ্যুৎ না থাকায় গরমে শিশু-বৃদ্ধরা অসুস্থ হয়ে পড়ছেন।

নারায়ণগঞ্জ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি (দুই) এর আড়াইহাজার জোনাল অফিসের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (ডিজিএম) টি এম মেজবাহউদ্দিন জানান, আমাদের প্রতিদিনের বিদ্যুতের চাহিদা ২ শত মেগাওয়াট। কিন্তু গত প্রায় এক সপ্তাহ ধরে ভুলতা গ্রিডের সিংহভাগ যন্ত্রপাতি কাজ না করায় আমরা বিদ্যুৎ পাই দৈনিক ৯০-৯৫ মেগাওয়াট। তিনি জানান, মেরামতের কাজ চলছে। আশা করি, দু'একদিনের মধ্যে সমস্যার সমাধান হতে পারে।

সোনারগাঁওয়েও চিত্র আলাদা নয়। এখানকার বাসিন্দাদের ভাষায়, বিদ্যুৎ গেলে আর আসার খবর থাকে না। বিদ্যুৎ না থাকলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। শিল্প-কারখানা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, স্কুল-কলেজ, বাসাবাড়ি সবখানেই একই দুরবস্থা। দিনে ১০-১২ বার বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে। ফলে কারখানার উৎপাদন অর্ধেকেরও নিচে নেমে এসেছে। পানির সংকট ভয়াবহ আকার নিয়েছে। প্রচণ্ড গরমে রাত জেগে কাটাচ্ছেন সাধারণ মানুষ।

সোনারগাঁওয়ের মোগরাপাড়া, পিরোজপুর, কাঁচপুর, সাদিপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় প্রতিদিন বিদ্যুতের একই সমস্যা দেখা যাচ্ছে। একাধিক কারখানার মালিক জানিয়েছেন, ঘন ঘন বিদ্যুৎ আসা-যাওয়ার কারণে মেশিন নষ্ট হচ্ছে। অনেক শ্রমিককে অলস বসে থাকতে হচ্ছে। এতে উৎপাদন যেমন কমছে, তেমনি আর্থিক ক্ষতিও হচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও চরম দুর্ভোগ চলছে।

ওয়ান ফার্মা লিমিটেড নামের (প্রাণি স্বাস্থ্য) ঔষধ কোম্পানির উপজেলা প্রতিনিধি আশরাফুল জানান, বিদ্যুৎ লোডশেডিং সোনারগাঁ উপজেলার জন্য এখন এক অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিদ্যুৎ একবার গেলে আর আসার খবর থাকেনা। এখানে প্রায় লক্ষাধিক মুরগির খামার রয়েছে। বিদ্যুতের কারণে মুরগি মরে যাচ্ছে। খামারিরা পথে বসছে।

এই তিন উপজেলায় বিদ্যুৎ সংকটের কারণে শিশু-বৃদ্ধরা সবচেয়ে বেশি কষ্টে আছেন। ডাক্তারদের মতে, প্রচণ্ড গরমের সঙ্গে বিদ্যুতের অভাবে হিট স্ট্রোক, ডায়রিয়া ও পানিবাহিত নানা রোগ ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি রয়েছে। ইতোমধ্যে বহু রোগী এসব সমস্যায় হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।

বিদ্যুৎ সংকট নিয়ে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২ এর জেনারেল ম্যানেজার প্রকৌশলী নূর মোহাম্মদ বলেন, ভুলতা গ্রিডে ট্রান্সফরমার বিকল হয়ে পড়ায় বড় ধরনের সংকট তৈরি হয়েছে। বর্তমানে জাতীয় গ্রিডে ঘাটতি থাকায় আমরা প্রয়োজন অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারছি না। তবে মেরামতের কাজ চলছে। আশা করছি অচিরেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে।

তবে স্থানীয় ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষ বলছেন, বিদ্যুৎ না থাকলে জীবনযাত্রা অচল হয়ে যায়। সরকারকে জরুরি ভিত্তিতে এ সংকটের স্থায়ী সমাধান করতে হবে।

নারায়ণগঞ্জের শিল্পনির্ভর এই তিন উপজেলার ওপর বিদ্যুৎ সংকটের যে প্রভাব পড়েছে তা এখন জাতীয় অর্থনীতিতেও প্রতিফলিত হচ্ছে। প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিদ্যুৎ সমস্যা দ্রুত সমাধান না হলে শিল্পের চাকায় বড় ধরনের ধাক্কা লাগবে, যা অর্থনীতির জন্য ভয়াবহ হবে।