
ফাইল ছবি
নারায়ণগঞ্জকে পরিচ্ছন্ন, সবুজ ও আধুনিক নগরীতে রূপান্তরের লক্ষ্যে জেলা প্রশাসন নতুন এক উদ্যোগ হাতে নিয়েছে। “গ্রিন অ্যান্ড ক্লীন নারায়ণগঞ্জ” নামের এ কর্মসূচির আওতায় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও জলাবদ্ধতা নিরসনে কার্যক্রম শুরু হয়েছে। প্রথম ধাপে ফতুল্লা ইউনিয়নকে পাইলট প্রজেক্ট হিসেবে নির্বাচিত করা হয়েছে।
সোমবার (১৮ আগস্ট) নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলায় প্রশাসনের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এক সভায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, ইউনিয়ন পরিষদ, বিভিন্ন সরকারি দপ্তর ও অংশীজনদের উপস্থিতিতে এ বিষয়ে আলোচনা হয়। সভা শেষে উপজেলা কমিটি ডাস্টবিন বসানোর উপযুক্ত স্থান নির্বাচন করতে সরেজমিনে পরিদর্শন করে। এরই ধারাবাহিকতায় ফতুল্লা ইউনিয়ন পরিষদকে বর্জ্য পরিবহনের জন্য জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে দুটি ভ্যান হস্তান্তর করা হয়।
নারায়ণগঞ্জ শিল্পনগরী হিসেবে দীর্ঘদিন ধরেই পরিচিত। কিন্তু জনসংখ্যা ও শিল্পকারখানার ঘনত্ব বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আবর্জনা ও জলাবদ্ধতা এ শহরের জন্য বড় অভিশাপে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন হাজার হাজার টন বর্জ্য উৎপাদিত হলেও তার সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ তৈরি হয়। অধিকাংশ এলাকায় খোলা জায়গায় আবর্জনা ফেলা হয়, যা থেকে দুর্গন্ধ, সংক্রমণ ও পরিবেশ দূষণ ছড়িয়ে পড়ে।
ফতুল্লা ইউনিয়নের চিত্রও ভিন্ন নয়। এখানে বহু শিল্পকারখানা, বাজার, ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা থাকায় প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ বর্জ্য তৈরি হয়। অথচ বর্জ্য পরিবহনের জন্য নির্দিষ্ট যানবাহন ও ডাস্টবিনের সংখ্যা একেবারেই অপ্রতুল। এতে করে সড়কের পাশে, খোলা ড্রেনে কিংবা খালি জায়গায় আবর্জনা জমে থাকে। সামান্য বৃষ্টিতেই ড্রেন উপচে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয়দের প্রাণের দাবি ছিল একটি টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থা।
জেলা প্রশাসক জাহিদুল ইসলাম মিঞা দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই ‘গ্রিন অ্যান্ড ক্লীন নারায়ণগঞ্জ’ বাস্তবায়নের জন্য নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করে আসছেন। তিনি মনে করেন, সুপরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ছাড়া কোনোভাবেই একটি আধুনিক নগর গড়ে তোলা সম্ভব নয়। তাই পরীক্ষামূলকভাবে ফতুল্লায় এ প্রকল্প চালু করা হচ্ছে।
প্রকল্প উদ্বোধনের সময় জেলা প্রশাসক বলেন, “আমরা চাই নারায়ণগঞ্জ হোক একটি সবুজ ও পরিচ্ছন্ন শহর। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও জলাবদ্ধতা নিরসনের মাধ্যমে নগরবাসীকে একটি স্বাস্থ্যকর পরিবেশ দেওয়া হবে। প্রাথমিকভাবে দুটি ভ্যান দিয়ে কাজ শুরু হলেও ভবিষ্যতে সফল হলে পুরো জেলায় এ কার্যক্রম সম্প্রসারণ করা হবে।”
তিনি আরও আশাবাদ ব্যক্ত করেন, “নারায়ণগঞ্জ হবে সবুজে ঘেরা, প্রাচ্যের ড্যান্ডি হবে বিশ্বসেরা।”
প্রথম ধাপে ফতুল্লা ইউনিয়নে প্রতিটি বাড়ি, দালান ও বাজার থেকে নির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ী বর্জ্য সংগ্রহ করা হবে। ইউনিয়নের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ডাস্টবিন স্থাপন করা হবে, যেখানে মানুষ তাদের দৈনন্দিন বর্জ্য ফেলতে পারবে। এরপর ভ্যানের মাধ্যমে বর্জ্য নির্দিষ্ট স্থানে পরিবহন করা হবে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, সিটি কর্পোরেশনের বাইরে এসব এলাকা থেকে সংগৃহীত বর্জ্য বক্তাবলী ইউনিয়নের নির্ধারিত স্থানে নিরাপদভাবে ফেলা হবে।
শুধু তাই নয়, ইউনিয়ন পরিষদ শ্রমিক নিয়োগ করবে এবং তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করবে। স্থানীয় মানুষকেও সচেতন করা হবে যেন তারা যেখানে-সেখানে আবর্জনা না ফেলে নির্দিষ্ট ডাস্টবিন ব্যবহার করেন।
ফতুল্লাকে প্রথম ধাপে নির্বাচিত করলেও প্রকল্পটির পরিধি সীমিত নয়। শহরের বাইরে থাকা আরও ছয় ইউনিয়ন আলীরটেক, কুতুবপুর, বক্তাবলী, কাশীপুর, গোগনগর ও এনায়েতনগরে ধাপে ধাপে একই ধরনের কার্যক্রম চালু করা হবে। প্রতিটি ইউনিয়নে দুটি করে ভ্যান সরবরাহ করা হবে। এতে শুধু নগরের ভেতর নয়, শহরতলীর মানুষও সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সুবিধা পাবে।
নারায়ণগঞ্জের অন্যতম বড় সমস্যা হলো জলাবদ্ধতা। বৃষ্টি হলেই অনেক এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়। বিশেষ করে ফতুল্লা, আলীরটেক, কুতুবপুর ও কাশীপুর এলাকায় এই দুর্ভোগ ভয়াবহ আকার ধারণ করে। এ সমস্যার অন্যতম কারণ হলো ড্রেনে জমে থাকা আবর্জনা। নতুন উদ্যোগের মাধ্যমে ড্রেনে বর্জ্য না ফেলতে উৎসাহ করা হবে এবং ড্রেন পরিষ্কার রাখার জন্য নিয়মিত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এতে জলাবদ্ধতা অনেকটাই কমে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে।
ফতুল্লার স্থানীয় বাসিন্দারা এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন। স্থানীয় ব্যবসায়ী মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, “আমাদের বাজারে প্রতিদিন প্রচুর আবর্জনা জমে। আগে এগুলো রাস্তায় পড়ে থাকত। এখন যদি নিয়মিত ভ্যান এসে সংগ্রহ করে নিয়ে যায়, তাহলে বাজারটা পরিষ্কার থাকবে।”
শিক্ষক সেলিনা আক্তার বলেন, “আবর্জনা ব্যবস্থাপনার অভাবে স্কুলের আশেপাশে দুর্গন্ধে থাকা যেত না। শিশুদের স্বাস্থ্যের জন্যও এটা বিপজ্জনক। নতুন উদ্যোগে যদি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশ পাওয়া যায়, তাহলে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবে আমাদের সন্তানরা।”
তবে শুধু ভ্যান সরবরাহ করলেই সমস্যার সমাধান হবে না। জনগণকে সচেতন করতে হবে, যাতে তারা যেখানে-সেখানে বর্জ্য না ফেলে নির্দিষ্ট স্থানে ফেলেন। শ্রমিকরা নিয়মিত দায়িত্ব পালন করছে কি না, তা নিশ্চিত করতে হবে। একইসঙ্গে ইউনিয়ন পরিষদকে সঠিক পরিকল্পনা অনুযায়ী ডাস্টবিন স্থাপন করতে হবে, যাতে জনগণ সহজেই ব্যবহার করতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এ ধরনের প্রকল্প দীর্ঘস্থায়ী করতে হলে আধুনিক ল্যান্ডফিল সাইট, রিসাইক্লিং সেন্টার ও কম্পোস্টিং প্ল্যান্ট গড়ে তুলতে হবে। এতে শুধু বর্জ্য সমস্যা কমবে না, বরং বর্জ্য থেকে নতুন সম্পদও তৈরি হবে।
জেলা প্রশাসনের এ উদ্যোগ যদি নিয়মিত পর্যবেক্ষণ, সঠিক তদারকি ও জনসচেতনতামূলক কর্মসূচির সঙ্গে সমন্বিত হয়, তাহলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই নারায়ণগঞ্জ একটি পরিচ্ছন্ন, আধুনিক ও সবুজ শহরে রূপান্তরিত হবে বলে আশা করছেন সচেতন নাগরিকরা।