বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪

|

বৈশাখ ১১ ১৪৩১

Advertisement
Narayanganj Post :: নারায়ণগঞ্জ পোস্ট

নারায়ণগঞ্জে বিশাল অস্ত্রভান্ডার!

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

প্রকাশিত: ১৭:১৮, ২৯ মার্চ ২০২৩

নারায়ণগঞ্জে বিশাল অস্ত্রভান্ডার!

ফাইল ছবি

নারায়ণগঞ্জ অতীতের সেই সন্ত্রাসের জনপদ তকমা থেকে অনেকটাই বেরিয়ে এসেছে। অস্ত্রের রাজনীতির চর্চা অতীতের মত না থাকলেও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের আশীবাদপুষ্ট সন্ত্রসীদের কাছে এখনও রয়ে গেছে বিশাল অস্ত্র ভন্ডার। এই অস্ত্রের পরিমান ঠিক কত তা কিছুটা অনুমান করা যেতে পারে ২০১৭ সালে রূপগঞ্জ থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার হওয়ার খবরে।

২০১৭ সালের ৩ জুন রূপগঞ্জের পূর্বাচল আবাসিক এলাকার লেক থেকে প্রায় অর্ধশতাধিক এম-সিক্সটিন রাইফেল, রকেট লঞ্চার, মর্টারশেলসহ বিপুল পরিমান গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়।

মূলত বিএনপির জোট সরকার আমলে পুলিশের সাথে ক্রসফায়ারে শহরের দুই ডজন সন্ত্রাসী নিহত হলেও উদ্ধার হয়নি অস্ত্র। ক্রসফায়ারে নিহত এসকল সন্ত্রাসীর প্রত্যেকেরই ছিল বিশাল অস্ত্র ভান্ডার। এদের বেশিরভাগ অস্ত্রই বর্তমানে হাতবদল হয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ক্যাডার বা ঝুট সন্ত্রাসীদের নিয়ন্ত্রণে আছে।

এদের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ছিলেন শহরের মিশনপাড়ার যুবদল নেতা মমিনউল্লাহ ডেভিড। দুর্ধর্ষ ডেভিডের ছিল বিশাল ক্যাডার বাহিনী। এছাড়াও তার কাছে ছিল বিশাল অস্ত্রের ভান্ডার। সেসময় অত্যাধুনিক সব অস্ত্র ডেভিড ও তার সন্ত্রাসী বাহিনী ব্যাবহার করত বলে আওয়ামীলীগ দলীয় সংসদ সদস্যসহ অনেকেই এখনো তাদের বক্তব্যে বলেন। ২০০৪ সালে র‍্যাবের সাথে ক্রসফায়ারে নিহত হন ডেভিড। তবে ডেভিডের মৃত্যুর পর তার অস্ত্র ভান্ডারের খোঁজ মেলেনি। উদ্ধার হয়নি সেই অস্ত্র।

প্রায় কাছাকাছি সময়ে ঘটে নারায়ণগঞ্জে তৎকালীন সময়ের সবচেয়ে আলোচিত হত্যাকান্ড। নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক তৈমুর আলম খন্দকারের ছোট ভাই ও ব্যাবসায়ী নেতা সাব্বির আলম খন্দকারকে নিজ বাড়ির সামনে গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা।

আলেচিত এই হত্যাকান্ডে সরাসরি সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ ছিল তৎকালীন জেলা ছাত্রদলের সভাপতি জাকির খানের বিরুদ্ধে। শহরের দেওভোগ এলাকায় ছিল জাকির খানের বিশাল ক্যাডার বাহিনী। জাকির খান ও তার ক্যাডারদের ব্যাবহারের জন্য ছিল বিশাল অস্ত্রের ভান্ডার, এটিও অভিযোগ আওয়ামীলীগ নেতাদের।

গত বছর অস্ত্রসহ গ্রেফতার হয় জাকির খান। এখন শহরের দেওভোগ এলাকায় জাকির খানের বিশাল কর্মী বাহিনী রয়েছে বলে জানা যায়। এখনও তাদের কাছে অস্ত্রের বিশাল ভান্ডার রয়েছে যা এখনও পুলিশ উদ্ধার করতে পারেনি, এমনটা বারংবার অভিযোগ উঠে।

২০১৮ সালে তৎকালীন নারায়ণগঞ্জ জেলা ছাত্রদলের সভাপতি মশিউর রহমান রনিকে অস্ত্রসহ গ্রেফতার করে পুলিশ। পরিবারের সদস্যরা জানায়, ঢাকা উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর নিখোঁজ হন রনি। এরপর থেকে তার কোন সন্ধান পাওয়া যাচ্ছিল না। পরিবার থেকে পুলিশ সাদা পোশাকে তুলে নিয়ে গেছে এমন দাবী করলেও তা অস্বীকার করা হয় পুলিশের পক্ষ থেকে। পরে রনিকে উদ্ধারের দাবী জানিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন স্বজনরা। পরে ১৭ সেপ্টেম্বর সোমবার ফতুল্লা থানায় অস্ত্রসহ গ্রেফতার দেখানো হয় রনিকে।

২০১৮ সালের ১৭ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জে হকার উচ্ছেদকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে জড়ায় আওয়ামী লীগের দুই পক্ষ। এসময় সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভিকে উদ্দেশ্য করে অস্ত্র তাক করে রাখতে দেখা যায় সাবেক যুবলীগ নেতা নিয়াজুলকে। তার অস্ত্রের লাইসেন্স থাকলেও এর মধ্যে আরো কয়েকজন অস্ত্র বের করে গুলি করে বলে অভিযোগ করেন আইভি। মূলত ২০০৪ সালের পর এদিনই প্রকাশ্য দিবালোকে আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের অস্ত্রের শোডাউন দেখেছিল নারায়ণগঞ্জবাসী। দুই পক্ষই অস্ত্র হাতে সংঘর্ষে জড়িয়েছিল সেদিন। আইভির হয়ে সেদিন গুলি চালিয়েছিল তার গানম্যান শফিক। এর মধ্যে সেদিন অস্ত্র বহন করছিলেন আওয়ামীলীগ নেতা আবু সুফিয়ানও, এমনটাও অভিযোগ উঠেছিল।

সবশেষ ২০২০ সালের ১ মার্চ এক বক্তব্যে আলোচনায় আসেন নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য একেএম শামীম ওসমান। জেলা পুলিশ লাইনসে পুলিশ মেমোরিয়াল ডে ২০০২০ উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে শামীম ওসমান বলেন, আমি একটা কথা বলতে চাই। ইদানীং ওয়াজে যাই অনেকে টিটকারি করে। ২ বেলা কোরআন শরীফ পড়ি। ২২ বছর ধরে তাহাজ্জুদ ছাড়ি নাই। ২০০১ সালের আগে আপনার টোটাল পুলিশ ফোর্সের কাছে যা অস্ত্র আছে তারচেয়ে বেশি অস্ত্র আমার কাছে ছিল। ২০০১ সালের আগে আমার রাজনৈতিক দর্শন এক রকম ছিল।

শামীম ওসমানের এমন বক্তব্যে সমালোচনা শুরু হলে ২ মার্চ সংবাদ মাধ্যমে এট ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে শামীম ওসমান বলেন, বক্তব্যে ২০০১ সাল উল্লেখ করলেও সালটি ভুল ছিল। মূলত এটি হবে ১৯৯১ সাল।

শামীম ওসমান জানান, স্বাধীনতা বিরোধীদের হামলা থেকে জীবন বাঁচানোর জন্য সেসময় অস্ত্র রাখতে হত। তবে আমাদের হাতে কেউ মারা যায়নি। বরং আমরাই মারা গেছি হামলায়। মূলত ১৯৯১ সালে এরশাদ সরকারের পতন ও গণতন্ত্র কায়েমের পরই দলের নেতাদের নির্দেশে অস্ত্রগুলো জমা দেন বলে জানান শামীম ওসমান। তৎকালীন নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার মমিনউল্লাহ পাটোয়ারীর কাছে সর্বোচ্চ আনঅফিসিয়াল অস্ত্র জমা দেন তিনি।

এছাড়াও সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জে ১২টি হত্যাকান্ডের সাথে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সাবেক সাংসদ মুহাম্মদ গিয়াসউদ্দিন জড়িত বলে দাবী করেন বর্তমান সাংসদ একেএম শামীম ওসমান। এসকল হত্যাকান্ডের বেশিরভাগই হয় আগ্নেয়াস্ত্রের মাধ্যমে। গিয়াসউদ্দিনের বিরুদ্ধে বিরোধীদের অভিযোগ রয়েছে তার অধীনেও ছিল বিশাল ক্যাডার বাহিনী যারা প্রত্যেকেই অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র ব্যাবহার করত যার কোনটি এখন পর্যন্ত উদ্ধার হয়নি।

২০০৪ সালে তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের ঘোষণার পরই বদলে যেতে শুরু করে নারায়ণগঞ্জের দৃশ্যপট। ঘোষণার পর থেকে স্থানীয় দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীদের সঙ্গে র‌্যাব আর পুলিশের বন্দুকযুদ্ধে ক্রসফায়ারে মারা যেতে শুরু করে একের পর এক সন্ত্রাসী। জেলার আলোচিত কুখ্যাত কিলার ৪০টি খুনসহ অর্ধ শতাধিক মামলার আসামি রকমত পুলিশের সঙ্গে বন্দুক যুদ্ধে ক্রসফায়ারে মারা যাওয়ার মধ্য দিয়ে নারায়ণগঞ্জে পুলিশ ক্রসফায়ারের খাতা খোলে। একে একে ক্রসফায়ারে পড়ে মারা যান ৩৭ মামলার আসামি জেলার আলোচিত শীর্ষ সন্ত্রাসী ও যুবদল ক্যাডার মমিন উল্লাহ ডেভিড, আদমজীর কদমতলী এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী ও বিএনপি ক্যাডার মিনিস্টার শাহ আলম ও যুবলীগের নজরুল ইসলাম, আদমজীর যুবলীগ কর্মী শফিকুল ইসলাম, আদমজীর শীর্ষ সন্ত্রাসী ও যুবলীগ ক্যাডার রগ কাটা জাফর, ফতুল্লার বিএনপি সন্ত্রাসী রুবেল, অস্ত্র ও মাদক ব্যবসায়ী বিপ্লব এবং আলমগীর হোসেন, বন্দরের মকবুল, কেন্দ্রীয় কৃষক লীগ নেতা টাওয়ার সেলিম, আবদুল্লাহ আল মামুন, কিলার রুবেল, আড়াইহাজারের কুখ্যাত ডাকাত সর্দার রওশন, জাকির খানের সহযোগী আহাদ, ফতুল্লার শীর্ষ সন্ত্রাসী ইবু বাহিনীর প্রধান ইবু, ডাকাত দানিয়েল, রওশন, রূপগঞ্জে মোহাম্মদ আলী, বন্দরে সুমন, আবুল হোসেন, মাহে আলম বিপু, সিদ্ধিরগঞ্জে মামুন, মোহাম্মদ আলী, আবুল হোসেন প্রমুখ। এছাড়া আততায়ীদের হাতে খুন হয় পাগলার দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী তোফাজ্জল। ২০০৫ সালের ২১ জুন স্থানীয় বিএনপি নেতা বিপ্লব ও আলমগীর হোসেনের কাছ থেকে একে-৪৭, নাইন এমএমসহ অত্যাধুনিক অনেক অস্ত্র উদ্ধার-ই বলে দিয়েছিল নারায়ণগঞ্জে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র রয়েছে।

জানা গেছে, গত ১৭ বছরে এসব অবৈধ অস্ত্রের বেশির ভাগই চলে গেছে নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন রাজনৈতিক ক্যাডারদের কাছে। ক্রসফায়ারে নিহত শীর্ষ সন্ত্রাসীদের সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে পরিচিত শহরের অনেক চিহ্নিত সন্ত্রাসী এখনও বীরদর্পে ঘুরে বেড়াচ্ছে।