
ফাইল ছবি
২০২৪ সালের ঐতিহাসিক জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার ছাত্রদল নেতা তাওহিদুল আলম জিসান। ছাত্র আন্দোলনের মাঠ পর্যায়ের এই সাহসী কর্মীকে শহীদের মর্যাদা দিয়ে গেজেটভুক্ত করার পর তা আবার বাতিল করে দিয়েছে সরকার।
রোববার (৩ আগস্ট) রাতে জারি করা সর্বশেষ প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়, “সরাসরি আন্দোলনে সম্পৃক্ত না থাকার কারণে” জিসানের নাম শহীদ তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
গেজেট নম্বর ৮১৮-এর অধীনে ইতোমধ্যেই জিসানকে শহীদ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ করে এই সিদ্ধান্ত পাল্টে দেওয়ায় বিস্মিত জিসানের পরিবার, সহযোদ্ধা ও রাজনৈতিক অঙ্গনের সহকর্মীরা।
জিসান ছিলেন রূপগঞ্জ উপজেলার ভুলতা ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক এবং একই ইউনিয়নের সাবেক সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক। তার বাড়ি ভুলতা ইউনিয়নের মাছুমাবাদ এলাকায়।
২০২৪ সালের ৩০ জুলাই রাতে ছাত্রদলের মিছিলে অংশগ্রহণ শেষে বাড়ি ফেরার পথে জিসান নির্মম হামলার শিকার হন। স্থানীয় মিঠাব ব্রিজের উপরে ওৎ পেতে থাকা দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ১৫-২০ জনের একদল সন্ত্রাসী তাকে কুপিয়ে ফেলে রেখে যায়। পরিবারের সদস্যরা খবর পেয়ে আহত জিসানকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
ঘটনার পরদিন নিহতের বাবা আলমগীর মোল্লা বাদী হয়ে মামলা করেন। মামলায় ছাত্রলীগ নেতা নাঈম ও তার বাবা কামালের নাম উল্লেখ করে আরও অজ্ঞাতনামা তিন-চারজনকে আসামি করা হয়। বিষয়টি স্থানীয় এবং জাতীয় সংবাদমাধ্যমেও গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশিত হয়।
জিসানের চাচা জাহাঙ্গীর মোল্লা জানান, তার ভাতিজা দনিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকার পাশাপাশি তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মিছিল ও সভা-সমাবেশে নিয়মিত অংশ নিতেন।
তার চাচা বলেন, ৩০ জুলাই রূপগঞ্জে অনুষ্ঠিত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মিছিলে অংশ নিয়েই বাড়ি ফেরার পথে ওৎ পেতে থাকা দুর্বৃত্তদের হামলায় জিসান নিহত হন। তার রক্তের দায় কেউ এড়াতে পারে না।
সরকারি প্রজ্ঞাপনে জিসানের নাম বাতিলের বিষয়ে কোনো বিস্তারিত ব্যাখ্যা না থাকলেও সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, গেজেট প্রস্তুতের সময় তার আন্দোলনে সরাসরি সম্পৃক্ততার যথাযথ নথি বা ভিডিও ফুটেজ না থাকায় নামটি বাদ দেওয়া হয়েছে।
তবে এই ব্যাখ্যাকে ‘রাজনৈতিক প্রতিহিংসা’ বলে দাবি করেছেন জিসানের পরিবার ও ছাত্রদল নেতারা।
তাদের মতে, সরকারদলীয় প্রভাবশালী মহল এবং স্থানীয় সন্ত্রাসীদের চাপেই গেজেট থেকে তার নাম বাদ দেওয়া হয়েছে।
নারায়ণগঞ্জ জেলা ছাত্রদলের সাবেক সহ-সভাপতি মাসুদুর রহমান মাসুদ বলেন, জিসান ছাত্রদলের সব সময়ের পরীক্ষিত কর্মী ছিল। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে বিএনপির হরতাল-অবরোধেও তার ভূমিকা ছিল চোখে পড়ার মতো। আমার সাথে অনেক আন্দোলনে সে অংশগ্রহণ করে। শহীদের তালিকা থেকে তার নাম বাদ দেওয়াটা চরম অন্যায় এবং দুঃখজনক।
তিনি আরও বলেন, ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর বিএনপির ডাকা হরতাল চলাকালে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার সময় পুলিশ ভ্যান থেকে তার সাহসী স্লোগান সেই সময় ফেসবুকসহ নানা সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছিল। সেই জিসানকে আজ শহীদের মর্যাদা থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। এটা যেন তার দ্বিতীয়বার হত্যার শামিল।
জেলা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি নাহিদ হাসান ভূঁইয়া বলেন, জিসান সরকারের পেটোয়া বাহিনী ও দলীয় ক্যাডারদের নির্মম আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন। সে দিন সরকারের রক্তপিপাসু নীতির বলি হয় এই সাহসী ছাত্র। অথচ আজ তার শহীদ স্বীকৃতিও কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। আমরা এই অন্যায়ের বিচার চাই।
জিসানের পরিবারের ভাষ্য, সরকার চাইলেই তার আন্দোলনে সম্পৃক্ততার ভিডিও, ছবি, বক্তব্য বা সহযোদ্ধাদের সাক্ষ্য সংগ্রহ করতে পারত। কিন্তু সেটি না করে বরং তাকে শহীদ ঘোষণার পর হঠাৎ করে বাদ দেওয়া উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণজাগরণে নিহতদের গেজেটভুক্ত তালিকায় প্রথম পর্যায়ে ৮৫২ জনের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পরবর্তীতে যাচাই-বাছাইয়ের নামে এই সংখ্যা কমিয়ে এনে ৩ আগস্টের প্রজ্ঞাপনে ৮৪৪ জন শহীদের নাম ঘোষণা করে সরকার। বাতিল করা হয় ৮ জনের নাম, যার মধ্যে অন্যতম তাওহিদুল আলম জিসান।
এপ্রসঙ্গে জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিঞা জানান, আমরা এই সংক্রান্ত গেজেট হাতে পেয়েছি। জিসানের নাম গেজেট থেকে বাদ দেয়া হয়েছে।
এই ঘটনার প্রতিবাদে জিসানের পরিবার আইনি লড়াইয়ের পাশাপাশি রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিবাদ কর্মসূচির প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানা গেছে। তারা চায়, জিসানের আত্মত্যাগের স্বীকৃতি ফিরিয়ে দেওয়া হোক।