
ফাইল ছবি
সত্তরের দশকের শেষ দিকে চট্টগ্রামের ফতেহাবাদ গ্রামে ‘অশিক্ষিত’ নামের একটি সিনেমার শুটিং করছিলেন পরিচালক আজিজুর রহমান। শুটিংয়ের ফাঁকে পত্রিকায় চোখ বুলাতেই একটি শিরোনামে তার চোখ আটকে যায়। ‘একটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনা’ শিরোনামের দুই কলামের সেই খবরে জানতে পারেন, নারায়ণগঞ্জের এক স্কুলছাত্র শৌচাগারে আটকে থাকার পর মারা গেছে। এমন খবরে মর্মাহত হন তিনি। সে সময়ই সিদ্ধান্ত নেন এ ঘটনা তিনি বড় পর্দায় তুলে আনবেন। কিন্তু তার সেই ইচ্ছাপূরণ করতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। কারণ, এমন একটি মর্মান্তিক ঘটনার গল্প নিয়ে সিনেমা তখন সময় দর্শক দেখবেন কি না, এটি একটি প্রশ্ন ছিল। এ ছাড়া ওই সময় নায়ক-নায়িকানির্ভর সিনেমার প্রাধান্য ছিল বেশি। তবু নাছোড়বান্দা পরিচালক তার সিদ্ধান্তে অটল, সিনেমা তিনি এ গল্পেই বানাবেন। নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস ছিল তার। খোঁজ শুরু করলেন প্রযোজকের। কিন্তু কেউই রাজি হচ্ছিলেন না। এ গল্পের সিনেমা চলবে না- এমন কথা সবাই মুখের ওপর বলে দিয়েছেন। একে একে দশ প্রযোজকের কাছে ধরনা দিয়েও কোনো উপায়ন্তর মিলল না। অবশেষে এসে হাজির হলেন তার ‘অশিক্ষিত’ সিনেমার প্রযোজক সত্য সাহার কাছেই। অনেকভাবে বুঝিয়ে তাকে রাজি করালেন। জীবদ্দশায় আজিজুর রহমান এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘সিনেমার জন্য প্রযোজক মিলছিল না। সবার একটিই কথা বাথরুমে ছাত্র মারা গেছে, এতে দেখানোর কী আছে। নিরুপায় হয়েই সত্যদাকেই (সত্য সাহা) ধরলাম। বোঝালাম, অশিক্ষিত সিনেমাতে তো তিন-চার কোটি টাকার ব্যবসা হয়েছে। আমার এ সিনেমার জন্য পাঁচ সাত লাখ টাকা বিনিয়োগ করুন। একটা রিস্ক নিন। আমার আগ্রহ দেখে তিনি রাজি হলেন।’
এরপর শুরু হলো সিনেমার প্রাথমিক প্রস্তুতির কাজ। চিত্রনাট্য লিখলেন আজিজুর রহমান, সংলাপ লিখলেন মোহাম্মদ রফিকুজ্জামান। তবে এর চিত্রনাট্যে অনেক কিছুই যুক্ত করতে হয়েছিল পরিচালককে। কারণ, দুই কলামের সেই খবরে বিস্তারিত তেমন কিছু ছিল না। তাই অনেক ঘটনা ও চরিত্রের জন্ম দিতে হয়েছে। শিল্পী বাছাইয়ের প্রক্রিয়া শুরু হলে স্কুলের ঘণ্টাবাদক হিসাবে ঠিক হলেন নায়করাজ রাজ্জাক। কিন্তু ওই প্রশ্নটা থেকেই যায়, নায়িকার কী হবে। নায়িকা ছাড়া কি আর সিনেমা হয়? বলা যায়, এ সিনেমার নায়িকা চরিত্র যুক্ত করাটাও ছিল নাটকীয় একটি ব্যাপার, অনেকটা কাকতালীয় বটে। একদিন পরিচালক আজিজুর রহমান তার কাকরাইলের অফিসের দরজা খুলে দেখতে পান, এক মহিলা অফিসের টেবিলের ওপর বসে সিগারেট ফুঁকছে। জানতে পারেন, এ মহিলা এক সুইপারের স্ত্রী, স্বামী অসুস্থ থাকায় সে ঝাড়ু দিতে এসেছে। আজিজুর রহমান সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘মহিলার ওই দৃশ্য দেখে মাথায় নায়িকা আইডিয়া আসে। নায়িকা হবে স্কুলের ঝাড়ুদারনি। সেই চরিত্রে অভিনেত্রী খুঁজতে খুঁজতে মনে হলো, এতে শাবানাই যথাযথ।’ এরপরই তিনি শাবানাকে নিয়ে ধোলাইখালের সুইপারপট্টিতে যান। তাদের পরিবেশ, আচার-আচরণ, পোশাক, চলাফেরা কাছ থেকে দেখেছেন শাবানা আর আজিজুর রহমান।
সিনেমার গল্পে দেখা যায়, স্কুল টানা ১১ দিন বন্ধ। সর্বশেষ ক্লাস চলছে। ঈদের ছুটিতে নানা বাড়ি যাবে এ আনন্দ সবার মনে। ছুটির ঘণ্টা পড়তেই বন্ধুদের সঙ্গে হই-হুল্লোড় করতে করতেই বের হয় সুমন। কিন্তু তাকে নিতে গাড়ি আসতে দেরি করে। এদিকে অপেক্ষা করতে করতে তার বাথরুম পায়। দপ্তরি তখনো গেটে তালা লাগায়নি, তাই স্কুলের বাথরুমেই ছুটে যায় সুমন। কিন্তু বের হতে গিয়ে দেখে দরজায় তালা। আতঙ্কিত হয়ে পড়ে সে। এদিকে সুমন বাড়ি না ফেরায় তার বাড়িতে সবাই দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। ঈদের আনন্দ বিষাদে পরিণত হয় তাদের জন্য। ছেলে হারানোর শোকে খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দেন সুমনের মা। সবাই মিলে সুমনকে খুঁজতে শুরু করে। পাড়ায় পাড়ায় মাইকিং করে হারানোর খবর প্রচার করা হয়। স্কুলের বাথরুম থেকে সুমন সব টের পায়। সে প্রাণপণে চিৎকার করে নিজের অস্তিত্ব জানাতে চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু সবই বিফলে যায়। কেউই তার কথা শুনতে পায় না। সবাই ধরে নেয়, এটা নির্ঘাত কোনো ছেলেধরার কাজ। দেখতে দেখতে ঈদ শেষ হয়ে যায়। কিন্তু তারপরও সুমনের অমানবিক আর কষ্টকর বন্দিজীবনের ছুটির ঘণ্টা বাজে না। ১১তম দিনে বাথরুমের কলের পানিও শেষ হয়ে যায়। অবশেষে বিদায় ঘণ্টা বাজে সুমনের জীবনে। তার এ বন্দিদশার করুণ কাহিনি সে বাথরুমের দেওয়ালে লিখে যায়। স্কুল খোলার পর সুমনের মৃত্যুর দায় স্বেচ্ছায় কাঁধে নিয়ে জেলে যায় দপ্তরি।
সিনেমাটির শুটিং সম্পন্ন করে সেন্সর বোর্ডে জমা দিলে বাধে নতুন বিপত্তি। বোর্ড কর্তৃপক্ষ জানায়, এ সিনেমা দেখলে কোমলমতি শিশুরা ভয় পাবে। তাদের ওপর বাজে প্রভাব পড়বে। তাই এটি মুক্তি দেওয়া যাবে না। কিন্তু পরিচালক দমে যাননি। তিনি এ সিনেমার একটি বিশেষ প্রদর্শনীর আয়োজন করেন। সেখানে আমন্ত্রণ জানানো হয় বেশ কিছু শিশু ও তাদের অভিভাবকদের। সিনেমা শেষে দেখা গেল, শিশুরা ভয় তো পেলই না, উলটো চোখ মুছতে মুছতে প্রেক্ষাগৃহ থেকে বের হচ্ছে, এমনকি অভিভাবকরাও। বাচ্চারা জানায়, তারা মোটেও ভয় পায়নি। এরপর এ সিনেমার মুক্তিতে আর কোনো বাধা থাকল না। কিন্তু ছাড়পত্র পাওয়ার পরও পরিচালককে নতুন আরও এক সংকটের মধ্যে পড়তে হয়েছিল। প্রথমদিকে কোনো প্রেক্ষাগৃহের মালিক সিনেমাটি নিতে চায়নি। অবশেষে ১৯৮০ সালে স্বরলিপি বানীচিত্রের ব্যানারে মাত্র ২০টি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি দেওয়া হয় ‘ছুটির ঘণ্টা’ সিনেমাটি। মুক্তির পরই আলচনায় চলে আসে। এরপর সারা দেশে কোথাও চার-পাঁচ সপ্তাহ, কোথাও এক-দুই থেকে পাঁচ মাসও এটি চলেছে। এরপর বাড়তে থাকে প্রেক্ষাগৃহের সংখ্যাও।
সিনেমাটির সংগীত পরিচালনায় ছিলেন সত্য সাহা। মোট গান ছিল চারটি। এর মধ্যে ‘একদিন ছুটি হবে অনেক দূরে যাব’ আর ‘আমাদের দেশটা স্বপ্নপুরী’ গানগুলো তখন দারুণ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। সিনেমাটির চিত্রগ্রাহক ছিলেন সাধন রায়, সম্পাদনায় ছিলেন নুরুন নবী। যে স্কুলছাত্রকে কেন্দ্র করে সিনেমার কাহিনি আবর্তিত হয়েছে সেই স্কুলছাত্র খোকার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন শিশুশিল্পী সুমন সাহা (মাস্টার সুমন নামে পরিচিত)। যিনি প্রযোজক সত্য সাহার ছেলে। বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেন রাজ্জাক, শওকত আকবর, খান আতাউর রহমান, শাবানা, সুজাতা, এ টি এম শামসুজ্জামান, জাদুশিল্পী জুয়েল আইচ, রবিউল আলম, শর্ব্বরী প্রমুখ।
চলচ্চিত্র পরিচালক আজিজুর রহমান। ১৯৩৯ সালের ১০ অক্টোবর বগুড়ার সান্তাহারে জন্মগ্রহণ করেন। স্থানীয় আহসানুল্লাহ ইনস্টিটিউট থেকে এসএসসি পাশ ও ঢাকা সিটি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেছেন। চারুকলা আর্ট ইনস্টিটিউটে কমার্শিয়াল আর্টে ডিপ্লোমা করেছেন। ১৯৫৮ সালে ‘এ দেশ তোমার আমার’ সিনেমায় এহতেশামের সহকারী হিসাবে ক্যারিয়ার শুরু করেন। একক পরিচালক হিসাবে তার নির্মিত প্রথম সিনেমা ময়মনসিংহের লোককথা নিয়ে ‘সাইফুল মূলক বদিউজ্জামান’। এটি মুক্তি পায় ১৯৬৭ সালে। আজিজুর রহমান ৫৪টি সিনেমা নির্মাণ করেছেন। সিনেমায় অবদানের জন্য ২০২৫ সালে তাকে একুশে পদক (মরণোত্তর) দেওয়া হয়। ২০২২ সালের ১৪ মার্চ তিনি মারা যান।