সোমবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৫

|

অগ্রাহায়ণ ২ ১৪৩২

Advertisement
Narayanganj Post :: নারায়ণগঞ্জ পোস্ট

সিদ্ধিরগঞ্জে ৫ ছাত্রের বলাৎকারের বিচারক চার মাতব্বর, ৪ লাখ টাকায় ‘মীমাংসা’

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

প্রকাশিত: ১১:২৭, ১৭ নভেম্বর ২০২৫

সিদ্ধিরগঞ্জে ৫ ছাত্রের বলাৎকারের বিচারক চার মাতব্বর, ৪ লাখ টাকায় ‘মীমাংসা’

প্রতীকী ছবি

একে একে বলাৎকার করেন পাঁচছাত্রকে। এক পর্যায়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে এক ছাত্র। এরপরই ঘটনা জানাজানি হয় স্বজনদের মধ্যে, এলাকায়। ক্ষিপ্ত এলাকাবাসী শিক্ষককে আটক করে উত্তম মধ্যম দেন। জুতার মালা পড়িয়ে শাস্তি দেন। পরবর্তীতে ভীড় জমায় মহল্লার কয়েকজন মাতব্বর।

যাদের দুজনের নামে রয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হত্যা মামলা। ঐ মাতব্বররা কৃষকদলের এক নেতাকে তাদের দলে ভীড়ান। বসানো হয়  শিক্ষকের বিরুদ্ধে সালিশ। সালিশে শিক্ষকের ১০ লাখ টাকা জরিমানা ধার্য্য করা হয়। এক পর্যায়ে জরিমানার টাকা কমিয়ে আনা হয় ৪ লাখ টাকায়। সেই ৪ লাখ  টাকা থেকে ১ লাখ টাকা দেওয়া হয় ভুক্তভোগী ছাত্রদের চার পরিবারকে। বাকি টাকা আত্মসাত করার অভিযোগ উঠে মাতব্বর, নেতা ও এলাকার ছিছকে পোলাপানের  বিরুদ্ধে। ঘটনাটি নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের আটি হাউজিং এলাকার। ৪ দিন পূর্বে বিচারের ঘটনা ঘটলেও এক কান থেকে দু’কান হয়ে পুরো এলাকাবাসী জেনে যাওয়ায় তারা এখন ক্ষুব্ধ। কিন্তু কিছুই বলতে পারছে না মাতব্বর, নেতা ও ছিছকে পোলাপানের ভয়ে। তবে তারা এর  সুষ্ঠ বিচার দাবি করেছেন। 

এলাকাবাসী জানায়, সিদ্ধিরগঞ্জের আটি হাউজিং এলাকার জমজম টাওয়ারস্থ নূরে মদিনা মাদ্রাসার মুহতামিম (প্রধান শিক্ষক) শরীফুল ইসলাম ইব্রাহীমের (৩২) বিরুদ্ধে পর পর  পাঁচছাত্রকে বলাৎকার করার অভিযোগ উঠে। তার বাবা সামসুল হক তালুকদার মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ও ভবনটির মালিক। এর আগে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরেও তিনি দুই ছাত্রকে তার রুমে নিয়ে বলাৎকারের অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছিলেন। 

অভিযোগ অনুযায়ী, শরীফুল গত দুই মাসে মাদ্রাসার পাঁচ ছাত্রকে তার কক্ষে নিয়ে বলাৎকার করেন। বিষয়টি জানাজানি হলে কৃষকদলের এক নেতা ও স্থানীয়রা ক্ষুব্ধ হয়ে তাকে আটক করে পুলিশের হাতে দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু এসময় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মামলার আসামি ও স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী ফরিদ মাস্টার ও মাতব্বর দেলোয়ার ঘটনাটি মীমাংসা করে দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে এলাকবাসীকে থানায় যেতে দেয়নি। সেই আশ্বাসের প্রেক্ষিতে গত ১১ নভেম্বর কৃষকদলের সাবেক এক নেতা, মহল্লার মাতব্বর ও বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মামলার আসামি দেলোয়ার, ফরিদ মাস্টার ও দলিল লেখক জালালকে নিয়ে সালিশ বসানো হয়। সালিশে অভিযুক্ত শিক্ষক শরীফুলের পিতা সামসুল হক তালুকদারকে প্রথমে ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা হলেও পরবর্তীতে ৪ লাখ টাকায় বিষয়টি মীমাংসা হয়। টাকাগুলো তিনি মীমাংসার পরপর ঐ দিনই দিয়ে দেন বিচারকদের কাছে। 

তবে ভুক্তভোগী ছাত্রদের পরিবার জানায়, তাদের ৪টি পরিবার ২৫ হাজার টাকা করে মোট এক লাখ টাকা পেয়েছেন। তবে একটি পরিবার কোনো টাকা পায়নি বলে জানিয়েছেন। বর্তমানে এক ছাত্র এখনো অসুস্থ রয়েছেন, চিকিৎসা নিচ্ছেন। অসুস্থ থাকায়  তার পড়ালেখা এখন বন্ধ।  

এদিকে এলাকাবাসী জানায়, ঘটনার পরও শিক্ষক শরীফুল ইসলাম ইব্রাহীমকে এখনো এলাকায় অবাধে চলাফেরা করছেন, মাদ্রাসাটি কার্যক্রমও চলমান রয়েছে। 

এ ব্যাপারে কথা বলতে চাইলে গতকাল ঐ মাদ্রাসা শিক্ষককে মাদ্রাসায় পাওয়া যায়নি। তবে মুঠোফোনে তারা বাবা ও মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক সামসুল হক তালুকদার তার বক্তব্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করে এ প্রতিবেদককে বিচারক ফরিদ মাস্টার এবং দেলোয়ারের সাথে কথা বলার পরামর্শ দেন।

এ ব্যপারে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে একটি মামলার আসামী ও বিচারক ফরিদ মাস্টার মুঠোফোনে বলেন, আমি কন্টাকটারি (একটি বিশেষ বাহিনীর) করি। ভুক্তভোগীদের একজন ঐ বাহিনীর  সদস্যের নাতি হয়। তাই আমি এই ঘটনার  বিচারে যুক্ত হই। তারা প্রথমে নারায়ণগঞ্জে গেলে সেখান থেকে তাদেরকে সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় পাঠায়। পরে তারা থানায় গেলে সেখানে তাদেরকে বলে বিষয়টা সামাজিকভাবে মীমাংসা করুন। কারণ বাচ্চারা কোর্টে ও থানায় যেতে আনইজি ফিল করবেন। এরমধ্যে আমরা হাউজিং এর যারা ছিলাম তাদের বক্তব্য নিয়ে আমরা নিজেরা মীমাংসা করে তিন লাখ টাকা জরিমানা করি। তবে আমরা প্রথমে চার লাখ টাকা ধার্য করেছিলাম। সেখান থেকে ভুক্তভোগী ৪ পরিবারকে ১ লাখ ও স্থানীয় যারা ছিল তাদেরকে লামসাম কিছু দিছি। 

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মামলার আসামি ও অপর বিচারক দেলোয়ার বলেন, আমরা জোহরের নামাজ পড়ে আসার সময় এলাকার কিছু ছেলে আসে এর মধ্যে একটা ছেলে আছে বিএনপির জাকির কইরা নাম। ওরা এক হুজুরকে ধরে আনে। পরে হাউজিং অফিসে নিলে আমি গিয়ে দেখি ঘটনা বলাৎকারের। আমি এখানে পাঁচ-সাত মিনিট ছিলাম। পরে আমি চলে আসছি। সেখানে পাঁচ-সাত জন সাংবাদিক ছিলেন আর ফরিদ মাস্টার ছিলেন। আপনি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলে পুরো তথ্য পেয়ে যাবেন। আমি এর বেশি কিছু জানি না। টাকার বিষয়ে তিনি বলেন, আমি শুনছি বিএনপির এক নেতা জাকির, সে কিছু পাইসে, সাংবাদিকগো দিছে, আর ভিকটিম চারজনকে কিছু দিসে। এর বেশি আমি কিছু জানি না।

এ  ব্যাপারে সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ওসি শাহীনুর আলম বলেন, আমাদের কাছে এ ঘটনায় কেউ কোনো অভিযোগ বা যোগাযোগ করেনি। পুলিশ কখনও কোনো ভুক্তভোগী পরিবারকে আইনের আশ্রয় নিতে অনুৎসাহিত করে না। ভুক্তভোগী ও তার পরিবার আসলে অবশ্যই আমরা এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করব।