সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫

|

অগ্রাহায়ণ ৩০ ১৪৩২

Advertisement
Narayanganj Post :: নারায়ণগঞ্জ পোস্ট

বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়নস লিগে না.গঞ্জের শুকতারা যুব সংসদ

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

প্রকাশিত: ১৮:৩৭, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫

বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়নস লিগে না.গঞ্জের শুকতারা যুব সংসদ

ফাইল ছবি

দেশের পেশাদার ফুটবলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ স্তরে আবারও গৌরবের সঙ্গে ফিরছে নারায়ণগঞ্জের ৫০ বছরের ঐতিহ্যবাহী ক্রীড়া প্রতিষ্ঠান শুকতারা যুব সংসদ।

প্রতিষ্ঠার ৫০ বছর অতিবাহিত করে দ্বিতীয়বারের মতো বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়নস লিগে ২০২৫-২৬ মৌসুমে অংশগ্রহণের জন্য বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) ক্লাব লাইসেন্স পেয়েছে ক্লাবটি। গত ৯ ডিসেম্বর বাফুফের লাইসেন্সিং বিভাগ আনুষ্ঠানিকভাবে শুকতারা যুব সংসদকে এই অনুমোদন প্রদান করে। চলতি ডিসেম্বর মাসেই বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়নস লীগ টুর্নামেন্টটি মাঠে গড়ানোর কথা রয়েছে।

ক্লাব কতৃপক্ষের আশা, এর মাধ্যমে ফিরে আসবে নারায়ণগঞ্জের ফুটবলের পুরনো ঐতিহ্য।

শুকতারা যুব সংসদ দেশের একমাত্র ক্লাব যেটি জেলা পর্যায় থেকে উঠে এসে বাফুফে আয়োজিত বাংলাদেশ ফেডারেশন কাপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে বাংলাদেশ পেশাদার লিগে অংশগ্রহণের যোগ্যতা অর্জন করেছিল।

এই অর্জন শুধুমাত্র শুকতারা ক্লাবের নয়, নারায়ণগঞ্জের হাজারও ফুটবলপ্রেমীর দীর্ঘদিনের স্বপ্ন, শ্রম ও অবদানের জাতীয় স্বীকৃতি বলে মনে করছেন ক্লাবটির কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, এই অর্জন জেলার ক্রীড়াঙ্গন ও নারায়ণগঞ্জবাসীর জন্য অত্যন্ত গর্বের বিষয়।

এর আগে ২০০৮ সালে জেলার প্রথম বিভাগে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর ২০০৯ সালে 'বসুন্ধরা চ্যাম্পিয়ন ক্লাব কাপ ফুটবল'–এ অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়ে প্রথম বারের মতো দেশের পেশাদার ফুটবলে (বি-লিগ) খেলার যোগ্যতা অর্জন করে শুকতারা যুব সংসদ।

১৯৭৪ সালের ১৫ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ শহরের জামতলা এলাকায় একঝাঁক তরুণ মেধাবী ফুটবলারের উদ্যোগে যাত্রা শুরু করে শুকতারা যুব সংসদ। প্রয়োজনীয় ক্রীড়া সরঞ্জাম ও সুযোগ সুবিধার অভাব থাকলেও ফুটবলের প্রতি ভালোবাসাকে পুঁজি করে এগিয়ে যেতে থাকে ক্লাবটি। দীর্ঘ পাঁচ দশক পেরিয়ে ছোট্ট উদ্যোগের সেই প্রতিষ্ঠানটি এখন দেশের একটি ক্রীড়া ব্র্যান্ডে পরিণত হয়েছে।

জেলা পর্যায় থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় বহু সাফল্য অর্জনের মধ্য দিয়ে  নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করেছে শুকতারা যুব সংসদ। দেশের ফুটবলের ইতিহাসে রেখেছে উল্লেখযোগ্য অবদান।

বর্তমানে শুকতারা যুব সংসদের অধীনে রয়েছে চারটি সক্রিয় ফুটবল দল। শুকতারা জুনিয়র ক্রীড়া চক্র (প্রথম বিভাগ), মাজেদ বাবুল স্মৃতি একাদশ ও শাহীন স্পোটিং ক্লাব (দ্বিতীয় বিভাগ)-এই চারটি ক্লাব নারায়ণগঞ্জ জেলা ক্রীড়া সংস্থার তালিকাভুক্ত ক্লাব।

১৯৭৪ সাল থেকে অদ্যাবধি নারায়ণগঞ্জ প্রথম বিভাগ ও দ্বিতীয় বিভাগে ক্লাবগুলো নিয়মিতভাবে অংশগ্রহণ করে আসছে। এই চারটি দলের মাধ্যমে শত শত খেলোয়াড়কে প্রশিক্ষণ দিয়ে জাতীয় মানের ফুটবলার হিসেবে তৈরী করেছে। ফলে ফুটবলার তৈরির অন্যতম প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিতি অর্জন করে করেছে শুকতারা যুব সংসদ। এই ক্লাব থেকে উঠে এসে জাতীয় দল এবং দেশের বড় ক্লাবগুলোতে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছেন অনেকেই।

আবাহনী ক্রীড়া চক্র, মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব, ব্রাদার্স ইউনিয়ন, মুক্তিযোদ্ধা ক্রীড়া সংসদ, ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাব, আরামবাগ, আজাদ স্পোর্টিং ক্লাব, ইষ্টার্ন স্পোর্টিং ক্লাব, লালমাটিয়া ক্লাব, ইস্কাটন ক্লাব, ওয়ান্ডারার্স ক্লাব, ওয়ারি ক্লাবসহ জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন দলে সাফল্যের সঙ্গে খেলে জাতীয় পর্যায়ের তারকা হয়েছেন এই ক্লাবের ফুটবলাররা। তাদের মধ্যে রয়েছেন জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক তারকা খেলোয়াড় গোলাম গাউস ও রেজাউল করিম লিটন।

এছাড়া জাতীয় লিগে খেলেছেন এই ক্লাবের ৬৭ জন খেলোয়াড়। মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে খেলেছেন লক্ষ্মী, আবাহনী ক্রীড়া চক্রে খেলেছেন প্রয়াত টুটুল ও রিপন, আবাহনী ক্রীড়া চক্র ও মুক্তিযোদ্ধা ক্রীড়া সংসদে খেলেছেন মোশাররফ হোসেন ও জুয়েল, আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবে খেলেছেন জোবায়ের নিপু, তপন, আব্দুল হালিম, হাফিজ, রহমত, রাকিবুল হাসান, ভিক্টোরিয়া স্পোটিং ক্লাব ও ওয়ারী ক্লাবে শহীদুল হক টুটু, হাবিবুর রহমান বাচ্চু, প্রয়াত মুক্তার হোসেন ও সাব্বির আলম খন্দকার, ইস্টার্ন স্পোর্টিং ক্লাবে ইব্রাহিম চেঙ্গিস, ওয়ারি ক্লাবে জাহাঙ্গীর কবির পোকন এবং ফকিরাপুল, লালমাটিয়া ও ইস্কাটন ক্লাবে খেলেছেন মেহেবুবুল হক তালুকদার টগর।

এছাড়া আন্তর্জাতিক লিগেও খেলেছেন শুকতারা যুব সংসদের খেলোয়াড়রা। ১৯৯০ সালে সুইডেন ও ডেনমার্কে বিকেএসপির খেলোয়াড় হিসেবে ডানা কাপ ও গোথিয়া কাপজয়ী দলে সাফল্যের সাথে খেলেছেন শুকতারা যুব সংসদের সাবেক খেলোয়াড় মাহমুদুল হক শাহীনসহ আরও বেশ কয়েকজন খেলোয়াড়।  

প্রতিষ্ঠার পর থেকেই নারায়ণগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী ক্রীড়া প্রতিষ্ঠান শুকতারা যুব সংসদ ফুটবলে ধারাবাহিক সাফল্য অর্জন করে আসছে। ১৯৭৭ সালে নারায়ণগঞ্জ দ্বিতীয় বিভাগ ফুটবল লিগে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মধ্য দিয়ে তাদের সাফল্যের যাত্রা শুরু হয়। পরের বছর শুকতারা জুনিয়র ক্রীড়া চক্র একই সাফল্য অর্জন করে।

১৯৮০-এর দশকে ক্লাবটি দেশের বিভিন্ন টুর্নামেন্টে নজরকাড়া পারফরম্যান্স দেখায়। ১৯৮০ সালে জুনিয়র দলের প্রথম বিভাগে রানার্স আপ হওয়া, একই সময়ে কক্সবাজারে শহীদ স্মৃতি ফুটবল টুর্নামেন্ট, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হুমায়ুন কবির স্মৃতি গোল্ডকাপ ও দোহার গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন হওয়া তাদের সাফল্যের ধারাবাহিকতা প্রমাণ করে।

১৯৮৯ থেকে ১৯৯৭ পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জ প্রথম বিভাগ ফুটবল লিগে চারবার রানার্সআপ হয় শুকতারা যুব সংসদ ক্লাবটি। ২০০৪ সালে প্রথম বিভাগে চ্যাম্পিয়ন হয়ে পরপর দুই বছর নিটল টাটা জাতীয় ফুটবল লিগে নারায়ণগঞ্জ জেলার চ্যাম্পিয়ন দল হিসেবে প্রতিনিধিত্ব করে শুকতারা যুব সংসদ।

দেশের আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ টুর্নামেন্টের মধ্যে ক্লাবটি অংশ নিয়েছে দেওয়ানগঞ্জ শহীদ স্মৃতি কাপ, মানিকগঞ্জ কুলফা গোল্ডকাপ, রাজবাড়ীর ভজ গোবিন্দ লাল শিল্ড ও টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসক গোল্ডকাপ টুর্নামেন্টে। ২০০৮ সালে আবারও প্রথম বিভাগে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর ২০০৯ সালে বসুন্ধরা চ্যাম্পিয়ন ক্লাব কাপ ফুটবলে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়ে শুকতারা যুব সংসদ অর্জন করে দেশের পেশাদার ফুটবলে (বি-লিগ) খেলার যোগ্যতা। খেলাধূলার পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নানা কর্মকান্ডেও সক্রিয়ভাবে কাজ করে আসছে শুকতারা যুব সংসদ।

বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়নস লিগে অংশগ্রহণের জন্য বাফুফের শর্ত পূরণ করেই শুকতারা যুব সংসদ গত ৯ ডিসেম্বর দ্বিতীয়বারের মতো বাফুফের লাইসেন্স অর্জন করেছে।

ক্লাবটির কর্মকর্তারা বলেন, খেলোয়াড়দের ধারাবাহিক প্রশিক্ষণ এবং শৃঙ্খলা ও চরিত্র গঠনের প্রতি বিশেষ জোর দেয়ার কারণেই শুকতারার খেলেয়াড়রা জাতীয় পর্যায়ে খেলার সুযোগ পেয়ে সাফল্য অর্জন করেছে। আগামীতে জাতীয় দল গঠনে প্রথম সারির খেলোয়াড় তৈরি ও সরবরাহে শুকতারা যুব সংসদ অতীতের ধারাবাহিকতা বজায় রাখবে বলেও মনে করেন তারা।

এই কর্মকর্তা আশা প্রকাশ করেন, পেশাদারিত্বের নতুন অধ্যায় লিখতে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন্স লিগে অংশগ্রহণই নয়, প্রতিযোগিতা করেতেই দল হিসেবেই মাঠে নামবে শুকতারার খেলোয়াড়রা। পঞ্চাশ বছরের অভিজ্ঞতাকে ভিত্তি করে আগামী দিনের শতবর্ষের ভিত্তি তৈরি করতে চায় ক্লাবটি।

শুকতারা যুব সংসদ বিসিএলে খেলার অনুমোদন পাওয়া নারায়ণগঞ্জ জেলার জন্য গৌরবের বিষয় হিসেবে উল্লেখ করে ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মোজাম্মেল হক তালুকদার বলেন, শুকতারা নারায়ণগঞ্জবাসীর গভীর আবেগ ও ভালোবাসার একটি জায়গা। দ্বিতীয়বার বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন্স লিগে খেলার সুযোগ পাওয়া মানে আবার নতুন একটি স্বপ্নের যাত্রা শুরু হলো। সবার আন্তরিক প্রচেষ্টা, ভালোবাসা ও সহযোগিতা নিয়েই শুকতারা যুব সংসদ সামনের দিকে এগিয়ে যাবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

শুকতারা ও জাতীয় দলের সাবেক খেলোয়াড় এবং বাফুফে'র কার্যকরী কমিটির সদস্য গোলাম গাউস বলেন, 'শুকতারা ক্লাবের জার্সি পড়েই আমি জাতীয় দলের ফুটবল খেলোয়াড় হয়েছি। এটা আমার জন্য অত্যন্ত গর্বের বিষয়। আমার সারা জীবনের যতো সাফল্য ও অর্জন রয়েছে তার সবটুকুই শুকতারার অবদান। আমাদের শুকতারার এই অগ্রগতিতে আমিসহ নারায়ণগঞ্জের প্রতিটি ফুটবলপ্রেমী আজ গর্বিত। নারায়ণগঞ্জের সুনাম রক্ষায় শুকতারা ভালো মানের একটি দল গঠন করে সাফল্য অর্জন করবে বলে আমার বিশ্বাস।'

ক্লাবের সাবেক যুগ্ন সম্পাদক মেহেবুবুল হক তালুকদার টগর বলেন, 'শুকতারা আগেও যখন বি লিগ খেলেছে তখন দেশের যেখানেই খেলা হয়েছে মাঠে দর্শকদের ভীড় ছিল। ফুটবলের সেই উত্তাপ আবার ফিরিয়ে আনাই আমাদের লক্ষ্য। আমাদের টিমের খেলোয়াড়রা নিয়মিত চর্চা, প্রশিক্ষণ নিয়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে পুরোপুরি প্রস্তুত রয়েছে। আশা করছি আমরা অতীতের মতো এবারও সাফল্য অর্জন করেন ঘরে ফিরবে আমাদের খেলোয়াড়রা।

ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক আনিসুর রহমান জুয়েল বলেন, 'শুকতারা বিসিএলে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার প্রত্যাশা নিয়েই শক্তিশালী দল গঠনসহ সব ধরণের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। এই দল নিয়ে আমরা সবাই আশাবাদী।