
ফাইল ছবি
নারায়ণগঞ্জে জুলাই বিপ্লবের পর থেকে বিগত এক বছরে ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় ৩০ টিরও অধিক গার্মেন্টস কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে।
এর ফলে হাজারও শ্রমিক গত এক বছরে চাকরি হারিয়েছেন। চাকরি হারিয়ে এসকল শ্রমিকদের অনেকেই নানা অপরাধ কার্যক্রমের সাথে জড়িয়ে যাচ্ছেন।
নারায়ণগঞ্জের কলকারখানা অধিদপ্তরের তথ্যমতে, নারায়ণগঞ্জে ছোট-বড় প্রায় ১ হাজার ৮৩৪টি পোশাক কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে গত এক বছরে ছোট বড় মিলিয়ে ৩০টির মত গার্মেন্টস কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এর মধ্যে অন্তত ১০টি গার্মেন্টস বিদেশে তৈরি পোশার রপ্তানি করতো। এগুলো হল এ.এস.টি গার্মেন্টস লিমিটেড, ডিজনী সুয়েটার লিমিটেড, ফতুল্লা ফ্রেব্রিকস লিমিটেড, মাষ্টার টেক্সটাইলস লিমিটেড, অবন্তি কালার টেক্সটাইল লিমিটেড, কনওয়ে নীট ওয়্যার লিমিটেড, বে ক্রিয়েশন লিমিটেড, মার্কারী নীট ওয়্যার প্রাইভেট লিমিটেড, নীট গার্ডেন প্রাইভেট লিমিটেড, লা মেইজন কচুর লিমিটেড।
কল কারখানা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, শুধুমাত্র এই ১০টি আরএমজি কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে নারায়ণগঞ্জে ৫ হাজার ২৯৭ জন শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন। এর বাইরে ছোট বড় অনেক তৈরি পোষাক কারখানা ও ডাইং এসময়ে বন্ধ হয়েছে। এর ফলে ধারণা করা হচ্ছে চাকরি হারানো শ্রমিকের সংখ্যা আরও বেশি।
নারায়ণগঞ্জ কলকারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তরের উপ মহাপরিদর্শক রাজীব চন্দ্র ঘোষ জানান, নারায়ণগঞ্জে ছোট বড় অনেক কারখানা বন্ধ হয়েছে। এর মধ্যে সরাসরি বিদেশে তৈরি পোশাক রপ্তানি করতো এমন কারখানা রয়েছে ১০টি। এর বাইরেও ছোট বড় বেশ কয়েকটি কারখানা বন্ধ হয়েছে।
নারায়ণগঞ্জ জেলা শিল্প পুলিশের সুপার (এসপি) সেলিম বাদশা জানান, নারায়ণগঞ্জে অনেকগুলো কারখানা গত এক বছরে বন্ধ হয়েছে। এসকল গার্মেন্টস বন্ধ হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে অর্ডার সংকট।
তিনি আরও জানান, বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানাগুলোর বেশিরভাগই ছোট। এগুলো সাব অর্ডারে কাজ করতো। অনেক ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত অর্ডার না থাকায় মালিকেরা এই গার্মেন্টসগুলো বন্ধ করে দেন।
নারায়ণগঞ্জ জেলা গার্মেন্টস শ্রমিক ফ্রন্টের সভাপতি সেলিম মাহমুদ জানান, পাঁচ আগষ্টের পর অনেক ব্যাবসায়ী পালিয়ে গেছে। এর ফলে অনেক ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে গেছে। বেশ কয়েকটি কারখানায় বেতন নিতে সমস্যা রয়েছে। বেতন ভাতা দিতে না পারার কারণেও কয়েকটি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এর ফলে হাজারও গত এক বছরে শ্রমিকেরা চাকরি হারিয়েছে।
গার্মেন্টসগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম জানান, গত এক বছরে ৩০টিরও বেশি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এর সবচেয়ে বড় কারণ হল ব্যাংকগুলো। বাংলাদেশ ব্যাংকের ভুল পলিসির কারণে কারখানাগুলো বন্ধ হচ্ছে। আরেকটা হল কিছু ব্রান্ড ও বায়ারের আনএথিক্যাল বায়িং প্র্যাক্টিস। অনেকে মাল নিয়ে পেমেন্ট দেয় না। আজ একজন আমাকে বলছে মাল নিয়ে পোর্টে ফেলে রেখে বলছে মালে প্রবলেম আছে ৫০ শতাংশ ডিসকাউন্ট দিতে হবে। তাহলে এখানে সাড়ে পাঁচ লাখ ডলারের মাল যদি আড়াই লাখ ডলার অর্থাৎ তিন কোটি টাকা যদি ডিসকাউন্ট দিতে হয় তাহলে তো শর্ট ফল হবে। এভাবেও অনেক ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, গ্যাস সংকটের কারণে গত পাঁচ বছর যাবৎ আমরা নির্ধারিত সময়ে শিপমেন্ট দিতে পারি না। ফলে বায়ারদের ডিসকাউন্ট দিতে হয়। এর ফলে আমরা শর্ট ফলে পড়ছি। এর ফলে কয়েক বছরের মাথায় গিয়ে ফ্যাক্টরিগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, আমরা সরকারের সকল দপ্তরের সাথে প্রতিনিয়ত কথা বলি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাথে গত এক বছর যাবৎ আমি নিয়মিত কথা বলছি। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক মনে করছি বিশ্বের সবচেয়ে বেস্ট প্র্যাক্টিসগুলো আমাদের দিয়ে করাবে। এর ফলে ফ্যাক্টরিগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
এদিকে নারায়ণগঞ্জ শিল্পাঞ্চল হওয়ায় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষ এই জেলায় ভিড় করছে। এক বছরের ব্যাবধানে এতগুলো ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চাকরি হারিয়ে এখন হাজারও যুবক বেকার হয়ে পড়েছে। জীবিকার তাগিদে শহরে ছুটে আসা এসকল মানুষ চাকরি হারিয়ে এখন নানা অপরাধমূলক কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়ছেন। এর ফলে নারায়ণগঞ্জে অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পেতে পারে বলে ধারণা করছেন নারায়ণগঞ্জ জেলার পুলিশ প্রশাসন।
এবিষয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার (অপরাধ) তারেক আল মেহেদী বলেন, নারায়ণগঞ্জ এমনিতেই অপরাধ প্রবণ এলাকা। এখানে বিভিন্ন জেলা থেকে মানুষ আসে এখানকার বিভিন্ন গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে কাজের জন্য। যারা এসব গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে কাজ করে তাঁরা অদিকাংশই নিন্ম শ্রেনির লোক। দেখা যায় তাদের ইনকামের মাধ্যমেই তাদের সংসার চলে। যখন তাদের চাকরি চলে যায় স্বাভাবিক ভাবেই তাদের পরিবারটা নিঃস্ব হয়ে যায়। মেয়েদের মেলায় দেখা যায় নারী ঘটিত ব্যবসায় লিপ্ত হয়ে যায় আর ছেলেদের বেলায় দেখা যায় তাঁরা হয় অটো চালাচ্ছে কিংবা চুরি-ছিনতাইয়ের মতো বা মাদক সেবন অথবা মাদক ব্যবসার সাথেও জড়িয়ে পড়তে পারে।
নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) প্রত্যুষ কুমার মজুমদার বলেন, মানুষ যখন কর্মহীন হিয়ে পরে তখনই এদের একটা বড় অংশ মাদকের সাথে কিংবা মাদক ব্যবসার সাথে জড়িয়ে পড়ে। এর ফলে অনেককে পাওয়া যায় চুরি-ছিনতাইয়ের সাথেও জড়িয়ে পরছে। এমনও অনেককে পাওয়া যায় যে ছিনতাইয়ের সাথে জড়িত। এখন সে ছিনতাইকারী তবে তাঁর পেছনের ইতিহাস খুজতে গিয়ে দেখা যায় সে এক সময় গার্মেন্টস শ্রমিক ছিলো। এমন প্রচুর আসামী পাওয়া যায়। নারায়ণগঞ্জ শিল্পাঞ্চল এলাকা হওয়ায় এখানে এসব অপরাধী বেশি পাওয়া যায়।