
ফাইল ছবি
নারায়ণগঞ্জের রাজনীতিতে আবারও ঝড় তুলেছে আড়াইহাজার উপজেলার সাবেক সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের বিতর্কিত নেতা নজরুল ইসলাম বাবুর একটি অডিও রেকর্ড ফাঁস। ফাঁস হওয়া এই অডিওতে বাবু দলীয় নেতা-কর্মীদের সাথে দেশকে অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্রমূলক পরিকল্পনার কথা শেয়ার করতে শোনা গেছে। শুধু তাই নয়, তিনি খোলাখুলিভাবে ওয়ার্ড পর্যায়ে ছোট ছোট টিম গড়ে তুলে একযোগে হামলার মাধ্যমে দেশব্যাপী অরাজকতা ছড়ানোর কথা বলেছেন। রাজনৈতিক মহলে ঘটনাটি ইতিমধ্যে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।
গত বছরের ৫ আগষ্ট স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের পতনের পর পালিয়ে যাওয়া আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীদের মাধ্যমে বিদেশে পালিয়ে থাকা এমপি-মন্ত্রীরা বারবার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ধ্বংসযজ্ঞের মাধ্যমে দেশকে অকার্যকর প্রমান করার জন্য। তেমনই এক বার্তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে গত বুধবার ছড়িয়ে পড়েছে। ফাঁস হওয়া বার্তায় বাবুর ভয়ঙ্কর সব নির্দেশনা আর পরিকল্পনার কথা উঠে আসে।
ফাঁস হওয়া অডিওর এক পর্যায়ে বাবুকে বলতে শোনা যায়, একযোগে নেমে এসে শহর-বন্দর অচল করে দিতে হবে। সচল যত কম থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে কী করছে এটা বোঝা যাবে না। যেদিন অচল হয়ে যাবে, সেদিন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ছাড়া বাংলাদেশ চলেনা এটা বোঝানো যাবে। বাংলাদেশের অনুভূতিতে লাগবে, তখন রেজাল্ট পাবে।”
তার এই বক্তব্য স্পষ্টতই পরিকল্পিতভাবে গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক স্থাপনা অচল করার হুমকি, যা রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতার জন্য ভয়ঙ্কর এক বার্তা মনে করছেন সুশীল সমাজ।
তিনি আরও বলেন, ওয়ার্ড পর্যায়ে টেলিগ্রাম গ্রুপ করেছি। ১০৮টি ওয়ার্ডে আমি চেষ্টা করছি সবাইকে গ্রুপ করতে। সেই কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশকে অশান্ত করার একটা নীল নকশা বাস্তবায়ন করা হবে। ঐ নীল নকশা কুমিল্লার মানুষ চট্টগ্রামে গিয়ে বাস্তবায়ন করতে হবে। চট্টগ্রামের মানুষ খুলনায় বাস্তবায়ন করতে হবে, আবার খুলনার মানুষ ঢাকায় বাস্তবায়ন করতে হবে। ঢাকার মানুষ আরেক বিভাগীয় শহরে এটা বাস্তবায়ন করতে হবে। এভাবে একদিনে লাল ছবি উপহার দিতে হবে, নয়তো কারো কানে পানি যাবে না।
এ বক্তব্য বড় সহিংসতার ইঙ্গিত দিচ্ছে। পরিকল্পনাটি শুধু স্থানীয় নয় বরং দেশব্যাপী একযোগে বাস্তবায়নের কৌশল সাজানো হচ্ছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বাবুর এই লাল ছবি মূলত খুনের দিকেই ইঙ্গিত দিচ্ছে। এটি কেবল একটি অডিও নয়, বরং আওয়ামী লীগের ভেতরে দীর্ঘদিন ধরে চলা গুপ্ত রাজনীতির এক নগ্ন বহিঃপ্রকাশ।
অডিওর আরেক অংশে বাবু মিটিংয়ে যুক্ত থাকা আরেক নেতা লিয়াকতকে উদ্দেশ্য করে বলেন, এখানে ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক আছেন। আমি সবাইকে সাক্ষী রেখে বলছি, আমি কোথায় আছি, কিভাবে আছি আর কিভাবে আসবো এটা না, লিয়াকত যদি ১০০০ মানুষ ব্যবস্থা করতে পারে আমি নিজে যেখান থেকেই হোক সেখানে যাবো। ঘটনা ঘটবেই।
তার এই বক্তব্য নতুন করে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। অনেকে বলছেন, আওয়ামী লীগের একজন সাবেক সংসদ সদস্য যদি প্রকাশ্যে “ঘটনা ঘটবেই” বলে হুমকি দেন, তবে দলীয় সিদ্ধান্তে কী ধরণের নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড লুকিয়ে আছে, তা সহজেই অনুমান করা যায়।
নজরুল ইসলাম বাবু আড়াইহাজার থেকে আওয়ামী লীগের টিকিটে সংসদ সদস্য ছিলেন। স্থানীয়ভাবে দলীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে তিনি ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করলেও নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে সবসময় আলোচনায় থেকেছেন। তার বিরুদ্ধে স্থানীয় প্রতিদ্বন্দ্বীদের দমন, দখলবাজি, চাঁদাবাজি, এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ বহুবার উঠেছে। এবার অডিও ফাঁসের ঘটনায় তার ভাবমূর্তি নতুন করে প্রশ্নবিদ্ধ হলো।
ফাঁস হওয়া অডিওটি প্রমাণ করছে, ৫ আগষ্ট পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ গুপ্ত সংগঠনের ন্যায় গোপনে দলীয় সাংগঠনিক কাঠামো ব্যবহার করে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি এবং জনগণকে আতঙ্কিত করার কৌশল নিচ্ছে।
অডিও ফাঁস হওয়ার পর থেকেই নারায়ণগঞ্জে সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা চলছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ নিয়ে তুমুল সমালোচনা হচ্ছে। বশির আহমেদ নামে এক ফেসবুক ব্যবহারকারী লিখেছেন, “দেশের প্রশাসন ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর নিকট বিশেষ অনুরোধ নজরুল ইসলাম বাবু সাবেক এমপি দেশে অশান্তি সৃষ্টি করার পরিকল্পনা করে ভিডিও দিয়েই বলে সবকিছু অচল করে দিবে সুতরাং তাকে আগামী ২৪ ঘন্টার মধ্যে আইনের আওতায় এনে রাষ্ট্রদ্রোহী এবং দুর্নীতিবাজকে গ্রেফতার করা বর্তমান সরকারের দায়িত্ব বলে মনে করি।”
মনির খন্দকার নামে অপরজন লিখেন, “আপনি সামনে থাইকেন, জঙ্গি হামলার পরিকল্পনা করছেন কিন্তু আপনি গুহায় থাকবেন এটা তো হবে না।”
নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির এক নেতা বলেন, “আওয়ামী লীগ সবসময়ই গণতান্ত্রিক আন্দোলন দমন করতে ষড়যন্ত্র করেছে। এখন নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেয়ার জন্য জনগণকে আতঙ্কিত করার পরিকল্পনা নিচ্ছে। বাবুর অডিওই তার প্রমাণ।”
এপ্রসঙ্গে জানতে চাইলে জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) তারেক আল মেহেদী বলেন, আমাদের গোয়েন্দা তৎপরতা সকল বিষয়ে খুবই সতর্কতার সাথে পর্যবেক্ষন করছে। আমরা এই বিষয়ে আরও সতর্ক অবস্থান নিয়েছি। যারাই দেশের অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করতে চাইবে, তাদের কাউকে ছাড় দেয়া হবেনা।