বৃহস্পতিবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৫

|

পৌষ ৯ ১৪৩২

Advertisement
Narayanganj Post :: নারায়ণগঞ্জ পোস্ট

দীর্ঘ ১৭ প্রতীক্ষার অবসান: দূরত্ব তারেক রহমানকে তাঁর রাজনৈতিক লক্ষ্য থেকে একবিন্দুও বিচ্যুত করতে পারেনি

মাহফুজুর রহমান পারভেজ 

প্রকাশিত: ০০:০৬, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৫

আপডেট: ০০:০৭, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৫

দীর্ঘ ১৭ প্রতীক্ষার অবসান: দূরত্ব তারেক রহমানকে তাঁর রাজনৈতিক লক্ষ্য থেকে একবিন্দুও বিচ্যুত করতে পারেনি

দেশে ফিরতে যুক্তরাজ্যের লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে তারেক রহমান

দীর্ঘ সতেরো বছর। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক সুদীর্ঘ ও ঘটনাবহুল অধ্যায়। এই সতেরোটি বছর দেশের মাটি, মানুষের সংস্পর্শ ও সম্মুখ রাজনীতি থেকে দূরে ছিলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। আজ তাঁর দেশে ফেরা নিছক কোনো সাধারণ প্রত্যাবর্তন নয়; এটি একদিকে যেমন এক রাজনৈতিক নেতার দীর্ঘ নির্বাসন-জীবনের সমাপ্তি, তেমনই অন্যদিকে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসে এক নতুন বাঁকবদলের ইঙ্গিত।

কন্টকময় প্রবাস জীবন: কষ্টের ১৭ বছর

২০০৭ সালের উত্তাল রাজনৈতিক পটভূমিতে দেশের মাটি ছাড়েন তারেক রহমান। সেসময় তাঁর বিরুদ্ধে তৈরি করা নানাবিধ অভিযোগ, শারীরিক অসুস্থতা এবং ১/১১-এর জরুরি অবস্থার প্রেক্ষাপটের সময় তাঁর দেশত্যাগ। এরপর শুরু হয় তাঁর এক ভিন্ন জীবন—নির্বাসনের জীবন।

শারীরিক ও মানসিক ধকল: প্রবাসে থাকার এই দীর্ঘ সময়ে তাঁকে কেবল রাজনৈতিক শূন্যতাই নয়, বরং অকথ্য শারীরিক ও মানসিক ধকলও সহ্য করতে হয়েছে। দেশে থাকার সময় তাঁর ওপর যে নিপীড়ন চালানো হয়েছিল, তার ফলে সৃষ্ট শারীরিক জটিলতার চিকিৎসা এবং আইনি লড়াই—এই দুটি বিষয় তাঁর প্রবাস জীবনকে করে তুলেছিল কণ্টকময়। বিদেশে বসে নিজ জন্মভূমিকে কেবল দূর থেকে দেখা এবং রাজনীতির কেন্দ্রে থেকেও সরাসরি অংশ নিতে না পারার কষ্ট একজন নেতার জন্য নিঃসন্দেহে এক গভীর যন্ত্রণা।

মায়ের কারাবাস: এই কষ্টের মাত্রা আরও বাড়ে

যখন তাঁর মা, দলের চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া কারাবন্দী হন। একদিকে নিজের অসুস্থতা, অন্যদিকে শত শত মাইল দূরে থাকা দলের সর্বোচ্চ নেতার অসুস্থতা ও কারাবাস—এই দ্বৈত চাপ তাঁর ব্যক্তিগত জীবন ও রাজনৈতিক কার্যক্রমকে আরও কঠিন করে তোলে। এই সতেরো বছর ছিল এক পুত্রের জন্য মা থেকে দূরে থাকার এবং একজন নেতার জন্য তাঁর সহযোদ্ধাদের থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার এক নীরব সংগ্রাম।

দূর থেকে নেতৃত্ব: নিরলস সাংগঠনিক শ্রম

শারীরিক দূরত্ব তারেক রহমানকে তাঁর রাজনৈতিক লক্ষ্য থেকে একবিন্দুও বিচ্যুত করতে পারেনি। বরং, এই সতেরো বছরে তিনি নিজেকে একজন নেপথ্যের দক্ষ সংগঠক ও আধুনিক রাজনৈতিক কৌশলীর ভূমিকায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের গুরুদায়িত্ব: বিদেশে থেকেও তিনি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের গুরুদায়িত্ব অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে পালন করেছেন। তিনি কেবল দলের কাঠামো ধরে রাখেননি, বরং তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত একটি আধুনিক ও সুসংগঠিত রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপিকে নতুন করে ঢেলে সাজানোর কাজ করেছেন।

ডিজিটাল সংযোগ: প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার করে তিনি দেশের জেলা, উপজেলা, থানা, এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ স্থাপন করেছেন। ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে সভা-সমাবেশ পরিচালনা করে তিনি প্রমাণ করেছেন যে, ভৌগোলিক দূরত্ব দিয়ে জনগণের সঙ্গে নেতার আত্মিক বন্ধনকে ছিন্ন করা যায় না।

ঐক্যবদ্ধতা ও দিকনির্দেশনা: দেশের অভ্যন্তরে সকল প্রতিকূলতা ও সরকারের নানাবিধ চাপে যখন বিএনপি দুর্বল হয়ে পড়ার উপক্রম হয়েছিল, তখন তাঁর সুদূরপ্রসারী দিকনির্দেশনা দলকে ঐক্যবদ্ধ রেখেছিল। আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অঙ্গনে দেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার পরিস্থিতি তুলে ধরার ক্ষেত্রেও তাঁর ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

জনগণের হৃদয়ের কাছে ফেরা: প্রত্যাবর্তনের তাৎপর্য

তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন কেবল একজন ব্যক্তির ফেরা নয়, এটি বাংলাদেশের কোটি মানুষের প্রত্যাশার প্রতিফলন। এই প্রত্যাবর্তন বিএনপির রাজনীতিতে এক নতুন উদ্দীপনা সৃষ্টি করবে।

প্রবাস জীবনে তাঁর কষ্ট, তাঁর নীরব পরিশ্রম আর দেশের মানুষের প্রতি তাঁর অবিচল আস্থা—এগুলোই তাকে জনগণের হৃদয়ের আরও কাছে নিয়ে গেছে। মানুষ যখন দেখেছে যে, এত আইনি জটিলতা, এত বাধা ও এত শারীরিক ভোগান্তির পরও একজন নেতা তাঁর আদর্শ থেকে সরে আসেননি, তখন সেই নেতার প্রতি মানুষের বিশ্বাস আরও গভীর হয়। তাঁর প্রত্যাবর্তন দেশের গণতান্ত্রিক পরিসরকে আরও উন্মুক্ত করতে এবং জনগণের ভোটাধিকার পুনরুদ্ধারের আন্দোলনকে আরও বেগবান করতে অনুঘটক হিসেবে কাজ করবে।

দীর্ঘ ১৭ বছরের এই পথ ছিল কেবলই সংগ্রাম, ত্যাগ ও অবিচল বিশ্বাসের। তারেক রহমানের এই প্রত্যাবর্তন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত, যা আগামীর দিনগুলিতে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে বলে মনে করছেন অনেকে।