সোমবার, ১১ নভেম্বর ২০২৪

|

কার্তিক ২৬ ১৪৩১

Advertisement
Narayanganj Post :: নারায়ণগঞ্জ পোস্ট

‘এক প্লেট ভাত ও কাঁচা মাছ খেতে দিত’

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

প্রকাশিত: ১২:০৬, ২৫ জুন ২০২৪

আপডেট: ১৪:২২, ২৫ জুন ২০২৪

‘এক প্লেট ভাত ও কাঁচা মাছ খেতে দিত’

ফাইল ছবি

সংঘবদ্ধ মানব পাচারকারী চক্রের ফাঁদ থেকে যুবকদের রক্ষা করা যাচ্ছে না। উচ্চ বেতনে চাকরির আশ্বাস দিয়ে বাংলাদেশ থেকে ঝুঁকিপূর্ণ পথে তাদের অবৈধভাবে পাচার করা হচ্ছে। ফাঁদে পড়া এমনই কয়েক যুবকের কাছ থেকে জানা গেল তাদের ভয়ংকর অভিজ্ঞতার কথা।

মালয়েশিয়ার উদ্দেশে যাত্রা করা ছয় যুবক ১১ মাস ২০ দিন মিয়ানমারে কারাভোগ শেষে গত ১০ জুন ফিরে আসেন। তাদের মধ্যে চারজন নিদারুণ কষ্ট ও নির্যাতনের কথা তুলে ধরেছেন। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, মিয়ানমারের জেলে এখনও আটক রয়েছেন এ উপজেলার ১৩ জন। ফিরে আসা যুবকদের পরিবারের মাঝে স্বস্তি ফিরলেও আটক ব্যক্তিদের পরিবারের দিন কাটছে উৎকণ্ঠায়।
অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করা সংগঠন অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রামের (ওকাপ) ফিল্ড অফিসার আমিনুল হক জানান, গত বছরের ২০ জুলাই মাহমুদপুর ইউনিয়নের কল্যান্দী গ্রামের সাত যুবক মালয়েশিয়া পাড়ি দিতে গিয়ে আটকা পড়েন মিয়ানমারের জেলে। নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসন ও আড়াইহাজার উপজেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় ১১ মাস ২০ দিন পর ছয়জন আড়াইহাজারে ফিরেছেন। বাকি একজন ছাড়াও বিশনন্দী ইউনিয়নের ১২ জন মিয়ানমারের জেলেই আছেন। ফিরে আসা ছয়জন হলেন– নাজমুল হোসেন, আব্দুল্লাহ মিয়া, হৃদয় মিয়া, আব্দুল হালিম, উজ্জ্বল মিয়া ও শাহীন মিয়া। 

নির্মম অত্যাচারের শিকার আব্দুল্লাহ মিয়া বলেন, কল্যান্দী গ্রামের দালাল দীন ইসলাম তাদেরকে মালয়েশিয়ায় ভালো চাকরির লোভ দেখান। দীন ইসলাম বলেছিলেন, তাদের মালয়েশিয়ায় পৌঁছে দিলে প্রত্যেককে চার লাখ টাকা দিতে হবে। ২০২৩ সালের ২০ জুলাই সাত যুবক দালালদের কথামতো রওনা হন মালয়েশিয়ার উদ্দেশে। কারোরই নেই পাসপোর্ট, ভিসা কিংবা ওয়ার্ক পারমিট। সবাই অবৈধ। চোখে তাদের রঙিন স্বপ্ন– সাগর পাড়ি দিয়ে কিংবা বন-জঙ্গল পেরিয়ে হলেও মালয়েশিয়া গিয়ে ভালো চাকরি পেলে সব দুঃখ ঘুচে যাবে।  প্রথমে সবাই বন্দর উপজেলার মদনপুর স্ট্যান্ড এলাকায় যান। এর পর বাসে চেপে চলে যান কক্সবাজার। সেখান থেকে অটোরিকশায় টেকনাফ। টেকনাফে ৩-৪ জন দালাল তাদের রিসিভ করেন। এখানে দালালদের ‘বড় ভাইজান’ বলে।

টেকনাফের কোনো এক দুর্গম পাহাড়ের গুহায় সাত যুবককে লুকিয়ে রাখা হয়। এখানেই দালালদের নির্মম-নিষ্ঠুর আচরণের সম্মুখীন হন স্বপ্নবাজ যুবকরা। দালালরা বাড়ি থেকে টাকা নিতে তাদেরকে ছুরি দেখান এবং হত্যার হুমকি-ধমকিও দিতে থাকেন। এভাবে গুহাতেই কেটে যায় সাত দিন। কোনোমতে দু’বেলা খেতে দেওয়া হতো তাদের। কিছু বললেই শুরু হতো শারীরিক নির্যাতন।

ফিরে আসা আরেক যুবক হৃদয় মিয়া জানান, গুহায় সাত দিন থাকার পর টেকনাফ থেকে ছোট ডিঙি দিয়ে সাগরের বড় ট্রলারে উঠিয়ে দেওয়া হয়। ট্রলারে উঠেই আতংক। সাগর পাড়ি দিচ্ছে ট্রলার। মিয়ানমার জলসীমার ৪ কিলোমিটার বাকি। এ সময় আড়াইহাজারের সাত যুবকসহ মোট ৪৩ জনকে আটক করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। আটকদের নিয়ে রাখা হয় মিয়ানমার কারাগারে। সেখানে ১১ মাস ২০ দিন কারাভোগ শেষে জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হয় বাংলাদেশে। ছয়জন ফিরলেও তাদের মধ্যে এক যুবক আসতে পারেননি। প্রায় এক বছর নিদারুণ যন্ত্রণা সইতে হয়েছে তাদের। সবচেয়ে বেশি কষ্ট করতে হয়েছে খাবারের। বেলা ১১টায় এক প্লেট ভাত ও অ্যাংকরের ডাল। বিকেল ৫টায় এক প্লেট ভাত ও কাঁচা মাছ। কেউ ভাত খেতে পারতেন না। কখনও অনেক কৌশলে কাঁচা মাছ ভেজে খেতেন। কখনও বা মাছ পুড়িয়েও খেতে হয়েছে তাদের।

ওকাপ-এর ফিল্ড অফিসার আমিনুল হক জানান, ওকাপ কর্মীরা জেনেছেন বিশনন্দী ইউনিয়নের মানিকপুর, কড়ইতলা গ্রামসহ বিভিন্ন এলাকার ৩৩ যুবক মালয়েশিয়ায় গেছেন। তাদের মধ্যে কয়েকজন মালয়েশিয়া পৌঁছেছেন। কেউ রাস্তায় আছেন, কিছু  নিখোঁজ। নিখোঁজ পরিবারের লোকজন তথ্য দিতে চান না।

আমিনুল হক আরও জানান, গত বছর ১১ মে থেকে তথ্য সংগ্রহ করে মিয়ানমারে আটকা পড়া ১৩ জনের তালিকা তৈরি করে ওকাপের আড়াইহাজার শাখা। ১৯ জুন মিয়ানমারে আটকে পড়াদের ফিরিয়ে আনতে জেলা প্রশাসকের সভাকক্ষে পরামর্শ চাওয়া হয়। প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কের নারায়ণগঞ্জের কর্মকর্তা জেলা প্রশাসক বরাবর লিখিত আবেদন করার পরামর্শ দেন। ৫ জুলাই আড়াইহাজারের ইউএনওর মাধ্যমে ভুক্তভোগী পরিবারের লোকজন জেলা প্রশাসক বরাবর লিখিত আবেদন করেন। ১০ জুলাই বিশনন্দী ইউপি চেয়ারম্যানের কাছ থেকে ১৩ জন নিখোঁজের একটি প্রত্যয়নপত্র নিতে বলা হয়। সব কাগজপত্র, ছবিসহ জেলা প্রশাসক বরাবর আবেদন করা হয় ১৭ জুলাই। এর মাধ্যমে ছয়জন ফিরে এসেছেন। ১৩ জন এখনও জেলে। 

আড়াইহাজারের ইউএনও ইশতিয়াক আহমেদ জানান, মানব পাচারকারীদের শনাক্তের কাজ প্রশাসনের পক্ষ থেকে করা হচ্ছে। গ্রামের যুবকদের স্বপ্ন দেখিয়ে অবৈধভাবে যারা বিদেশে পাচার করছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কেউ যাতে পাচারকারীদের ফাঁদে না পড়ে, সে জন্য সচেতনমূলক কার্যক্রম চালানো হচ্ছে।