সোমবার, ০১ ডিসেম্বর ২০২৫

|

অগ্রাহায়ণ ১৬ ১৪৩২

Advertisement
Narayanganj Post :: নারায়ণগঞ্জ পোস্ট

এবার পদ্মা মেঘনায় ডিজেল গায়েব

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

প্রকাশিত: ১৯:৩৭, ১ ডিসেম্বর ২০২৫

এবার পদ্মা মেঘনায় ডিজেল গায়েব

ফাইল ছবি

চট্টগ্রাম থেকে পাইপলাইনে তেল সরবরাহ শুরুর পর যমুনার জ্বালানী তেল গায়েব হয়ে যাওয়ার পর এবার পদ্মা ও মেঘনা অয়েল কোম্পানির নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল ডিপোতে পাওয়া গেছে বড় ধরনের ডিজেল ঘাটতি। এই দুই প্রতিষ্ঠানের হিসাব অনুযায়ী প্রায় দেড় লাখ লিটার ডিজেল ডিপোতে এসে মিলছে না হিসেব। কোথায় গেছে এই বিপুল পরিমাণ তেল, তা নিয়ে তদন্ত শুরু হয়েছে। তবে কর্তৃপক্ষ বলছে, পাইপলাইনে তেল গায়েব হওয়ার সম্ভাবনা নেই; বরং মিটার বা ট্যাংকের সক্ষমতার ত্রুটির কারণে এই অমিল দেখা দিতে পারে।

জ্বালানি তেল আমদানি ও সরবরাহে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন। বিপিসির অধীন তিনটি প্রতিষ্ঠান পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা বিপণন কোম্পানি হিসেবে সারাদেশে বাজারে তেল সরবরাহ করে। চট্টগ্রাম পতেঙ্গা টার্মিনাল থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে ডিজেল পাঠানো হচ্ছে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা ও গোদনাইল ডিপোতে। পরীক্ষামূলকভাবে চালু হওয়া এই পাইপলাইন ব্যবস্থায় বড় ধরনের ক্ষতি হওয়ার সুযোগ নেই বলে দাবি করেছিল বিপিসি। কিন্তু বিপরীতে দেখা গেল সরবরাহের পরিমাণ এবং ডিপো ট্যাংকে মাপা পরিমাণের মধ্যে বিরাট অমিল।

গত ১০ নভেম্বর মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেডের গোদনাইল ডিপোতে ২৫ লাখ ৩৭ হাজার ৭২৪ লিটার ডিজেল পাঠানো হয়। ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ধরে তেল মাপার প্রচলিত হিসেবে এত পরিমাণ সরবরাহ হবার কথা। কিন্তু ডিপোর ট্যাংকে মাপতে গিয়ে পাওয়া গেছে মাত্র ২৪ লাখ ২২ হাজার ৪৭৩ লিটার। হিসাব অনুযায়ী ঘাটতি ১ লাখ ১৫ হাজার ২৫১ লিটার। অর্থাৎ সরবরাহের তুলনায় সাড়ে চার শতাংশের বেশি ডিজেল কম পাওয়া গেছে, যা তেলের নির্ধারিত স্বীকৃত ক্ষতির সীমার অনেক বাইরে। বিপিসি সর্বোচ্চ শূন্য দশমিক ৩৩ শতাংশ পর্যন্ত ক্ষতিকে অনুমোদন করে। সেই তুলনায় মেঘনায় পাওয়া এই ঘাটতি বিপুল।

এ বিষয়ে মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শাহীরুল হাসান জানিয়েছেন, পাইপলাইনের মাধ্যমে সরবরাহ এখনো পরীক্ষামূলক পর্যায়ে রয়েছে। তাই ঘাটতি কেন হচ্ছে তা নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না। দুই প্রান্তের মিটার, ট্যাংকের সক্ষমতা অথবা তাপমাত্রা পরিবর্তনের কারণে তেলের ঘনত্ব কমে যাওয়ার বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে তিনি জানান। শীতের সময় তাপমাত্রা কমে তেলের ঘনত্ব পরিবর্তিত হতে পারে, যা মাপের ওপর সামান্য প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করেন তিনি। তবে এত বড় ঘাটতিকে তারা অস্বাভাবিক বলেই উল্লেখ করেছেন।

এরপর ১১ নভেম্বর পদ্মা অয়েল পিএলসির গোদনাইল ডিপোতেও সরবরাহ করা হয় ডিজেল। বিপিসির তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম থেকে ২৫ লাখ ২০ হাজার ৭৭০ লিটার ডিজেল পাঠানো হয়। ডিপোতে মেপে দেখা যায় ২৪ লাখ ৯৩ হাজার ৪৬৮ লিটার। হিসাব অনুযায়ী এখানে ঘাটতি ২৭ হাজার ৩০২ লিটার। যদিও পদ্মা অয়েলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মফিজুর রহমান দাবি করেছেন, পাইপলাইনের দুই প্রান্তের মিটার অনুযায়ী তাদের হিসাব বরং ১ হাজার ৮০০ লিটার বেশি দেখাচ্ছে। তাঁর মতে, শীতকালীন তাপমাত্রা কমে গেলে ট্যাংকে মাপার সময় তেলের ঘনত্ব কমে যেতে পারে। নিয়মিত সরবরাহ শুরু হলে এসব অমিল দূর হয়ে যাবে বলেও তিনি আশা প্রকাশ করেন।

তবে ডিপো-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ট্যাংকে তেল পরিমাপের সনাতনী পদ্ধতির কারণে এখনো অনিয়মের সুযোগ রয়ে গেছে। ডিপ স্টিক নামের লম্বা রড পানিতে ডুবিয়ে ট্যাংকের গভীরতা এবং তেলের উচ্চতা মাপা হয়। মাত্র দুই মিলিমিটার ব্যবধানে গভীরতা কম দেখানো গেলেই প্রায় ১ হাজার ১৮০ লিটার পর্যন্ত ঘাটতি দেখানো সম্ভব। ফলে আগের মতো জালিয়াতির সুযোগ এখনো পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। তারা মনে করছেন, ট্যাংকের হালনাগাদ সক্ষমতা যাচাই না করে পুরোনো চার্ট ব্যবহার করার কারণেও বড় অমিল তৈরি হতে পারে।

এর আগে গত সেপ্টেম্বরে যমুনা অয়েল কোম্পানির ফতুল্লা ডিপোতে পৌনে ৪ লাখ লিটার ডিজেল ঘাটতি ধরা পড়ে। প্রথম আলোর প্রকাশিত প্রতিবেদনের পর তদন্ত কমিটি গঠন করে বিপিসি। নতুন করে ওই ডিপোর দুটি ট্যাংকের সক্ষমতা যাচাই করে দেখা যায় বাস্তবে ট্যাংকের ধারণক্ষমতা চার্টে উল্লেখিত সক্ষমতার চেয়ে ৭৭ হাজার ৪৯২ লিটার বেশি। অর্থাৎ ট্যাংকের প্রকৃত সক্ষমতা গোপন রেখে অতীতে পরিমাণ কম দেখানো হয়েছিল, যার মাধ্যমে চুরির সুযোগ তৈরি হয়। সেই তদন্তের অগ্রগতি এখনো প্রকাশ হয়নি।

এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক মো. আমিনুল হক জানিয়েছেন, পাইপলাইনে তেল গায়েব হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তেল কোথাও না কোথাও থাকবেই এবং তা ধরা পড়বেই বলে তিনি মন্তব্য করেন। দুই প্রান্তের মিটার রক্ষণাবেক্ষণে কাজ চলছে। মিটার ঠিক হওয়ার পর তিন প্রতিষ্ঠানের সব ট্যাংকের সক্ষমতাও নতুন করে যাচাই করা হবে। এরপরই পাইপলাইন আনুষ্ঠানিকভাবে বিপণন কোম্পানির কাছে হস্তান্তর করা হবে, যা করতে তাদের আরও দুই মাস সময় লাগতে পারে।

গত মাসে জ্বালানিসচিবের সভাপতিত্বে এক বৈঠকে বিপিসি চেয়ারম্যান জানিয়েছেন, জ্বালানি তেল সরবরাহে পাইপলাইন চালু হওয়ায় একটি অসাধু চক্র বিশৃঙ্খলা তৈরির চেষ্টা করছে। শ্রমিক সংগঠনের নেতাদের দৌরাত্ম্য বন্ধে নিয়মিত নজরদারি এবং দায়ীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে তেল চুরির বিভিন্ন ঘটনা পর্যালোচনা করে সুপারিশ দিতে একটি কমিটি গঠনের সিদ্ধান্তও হয়।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম জানিয়েছেন, জাহাজ থেকে পাম্প পর্যন্ত তেল চুরির ঘটনা বহুদিনের পুরোনো বিষয়। সেই চুরি ঠেকাতে পাইপলাইন নির্মাণ করা হলো। তারপরও তেল গায়েব হতে থাকলে তা উদ্বেগজনক। ট্যাংকের সক্ষমতা কমানো এবং মিটার বিভ্রাটের পিছনে কারা রয়েছে তা নিরপেক্ষ তদন্ত ছাড়া জানা যাবে না। তিনি মনে করেন, রাজনৈতিক প্রভাবহীন নাগরিক কমিটি বা আদালতের তত্ত্বাবধানে স্বাধীন তদন্ত ছাড়া এই রহস্য উন্মোচন সম্ভব নয়।

ডিজেল ঘাটতির এই অমিল এবং অতীতের চুরির অভিযোগ মিলিয়ে আবারও প্রশ্ন উঠছে দেশের তেল সরবরাহ ব্যবস্থাপনার সচ্ছতা নিয়ে। পাইপলাইন যুগেও যদি তেল হারিয়ে যায়, তবে চুরি রোধে আর কী ব্যবস্থা প্রয়োজন, তা জানতে আগ্রহী সাধারণ মানুষ। কর্তৃপক্ষ তদন্ত শেষ করলে প্রকৃত কারণ জানা যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।