
প্রতীকী ছবি
গত ১১ অক্টোবর নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও এলাকায় পাঁচ বছরের নিষ্পাপ ছেলে রোহানকে বিষ পান করিয়ে মা মিতু বেগম বিষপানে আত্মহত্যা করেন। দুঃখজনকভাবে একই দিনে সোনারগাঁয় স্বামী-স্ত্রীসহ চারজনের আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে। শুধু তাই নয়, নারায়ণগঞ্জের সংশ্লিষ্ট থানা ও হাসপাতাল সূত্রে ২০২১ সালে ২৩৮ জন, ২০২২ সালে ২৯৪ জন, ২০২৩ সালে ২৮৪ জন, ২০২৪ সালে ৩০৪ জন ও ২০২৫ সালের ১০ অক্টোবর পর্যন্ত ২৪৫ জনের আত্মহত্যার তথ্য পাওয়া গেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, আত্মহত্যার নেপথ্যে পরকীয়া প্রেম, প্রেমে ব্যর্থতা, মাদক সেবন, যৌতুক প্রথা, বাল্যবিবাহ, অভাবের তাড়না, বেকারত্বের অভিশাপ, প্রতারণা ও আকাশ সংস্কৃতিকে কারণ হিসেবে দেখছেন অনেকে।
আত্মহত্যা রুখতে স্থানীয়ভাবে কোনো বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা, জনপ্রতিনিধি বা সমাজকর্মীকে সেমিনার, সিম্পোজিয়াম কিংবা কাউন্সেলিং করতে দেখা যায় না। সরকারিভাবেও কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
জেলার সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে বন্দর থানায়। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে রূপগঞ্জ, আর তৃতীয় হয়েছে সোনারগাঁ উপজেলা।
নারায়ণগঞ্জ শহরের বাবুরাইল বউবাজার এলাকার একটি ফ্ল্যাট থেকে গত ১৬ সেপ্টেম্বর স্বামী, স্ত্রী ও চার বছরের সন্তানের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। আশপাশের ভাড়াটিয়ারা বলেন, গৃহকর্তা শিপলু এক সমিতিতে ম্যানেজার হিসেবে কাজ করতেন। করোনার সময় গ্রাহকদের ১৫ কোটি টাকা ফেরত না দেওয়ায় তাঁর নামেও মামলা হয়েছে। হয়তো এই হতাশা থেকে স্ত্রী-সন্তানদের খুন করে নিজে আত্মহত্যা করেছেন।
স্থানীয় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা একশন এইডের প্রোগ্রাম অর্গানাইজার উৎসব বৈরাগী বলেন, ‘আত্মহত্যা রোধ করা তো যাচ্ছেই না, উপরন্তু তা বেড়ে যাচ্ছে।’
নারায়ণগঞ্জ জজকোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আবুল বাশার রুবেল বলেন, ‘আত্মহত্যার ঘটনাগুলোর সঠিক তদন্ত করে যদি ব্যবস্থা নেওয়া হতো, তাহলে সমাজে আত্মহত্যার প্রবণতা কমে যেত।’
গোলাকান্দাইল ইউপি চেয়ারম্যান নাসিরউদ্দিন বলেন, ‘এ থেকে উত্তরণের দুটি পথ রয়েছে—প্রথমত, পারিবারিক বন্ধন অটুট করা; দ্বিতীয়ত, জনপ্রতিনিধি, শিক্ষক, ইমাম ও সুধীজনের সমন্বয়ে সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালানো।’
সমীক্ষায় দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি নারী-পুরুষ, শিক্ষার্থী এ পথ বেছে নিয়েছে মান-অভিমান থেকে। এ ছাড়া পারিবারিক কলহে ৩.১৪ শতাংশ, হতাশাগ্রস্ততা থেকে দুই শতাংশ, মানসিক সমস্যার কারণে ১.৮ শতাংশ, আর্থিক সমস্যার কারণে ৩.৮ শতাংশ, উত্যক্ত, ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির শিকার হয়ে আত্মহত্যার পথে গেছে ৩.১৩ শতাংশ।
এ ছাড়া আপত্তিকর ছবি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়াতেও আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে।
নারায়ণগঞ্জের পুলিশ ও হাসপাতাল সূত্রমতে, গত পাঁচ বছরে নারায়ণগঞ্জে ২৭৬ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি তানসেন রোজ বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রোমান্টিক সম্পর্কে ব্যর্থতা এবং আর্থিক সংকটের কারণে বেশি আত্মহত্যা করে থাকেন। আর স্কুল, কলেজ ও মাদরাসায় পড়ুয়ারা এই পথ বেছে নেয় মূলত পরিবারের সদস্যদের ওপর মান-অভিমানের কারণে। এ বয়সী শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে প্রেমঘটিত।’
জরিপ বলছে, গেম খেলতে বাধা দেওয়ায় তিনজন, পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে দুজন, মোবাইল ও মোটরসাইকেল কিনে না দেওয়ায় যথাক্রমে দুই ও একজন শিক্ষার্থী আত্মহত্যার পথ বিছে নিয়েছে।
কাঞ্চন সলিমউদ্দিন চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের মনোবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক ফারজানা আহম্মেদ বলেন, ‘মিডিয়াসহ অন্যান্য প্রচারমাধ্যমে আত্মহত্যা প্রবণতা কমাতে ব্যাপক হারে গণসচেতনতা বাড়াতে হবে। পাশাপাশি বাল্যবিবাহ, যৌতুক প্রথাসহ অন্যান্য সামাজিক অন্যায়-অবিচার-অস্থিরতা কমিয়ে আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তা বাড়াতে হবে।’
রূপগঞ্জ থানার ওসি তারিকুল ইসলাম বলেন, ‘সামাজিক, পারিবারিক ও অর্থনৈতিক কারণেই আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে থাকে। এটি প্রতিরোধ সমাজের জন্য নিঃসন্দেহে বড় চ্যালেঞ্জ।’
রূপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম জয় বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে মূল সমস্যা সামাজিক ও পারিবারিক। তবে তা রোধ করতে হলে সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ড বাড়াতে হবে। পাশাপাশি পরিবারকেও দায়িত্বশীল হতে হবে।’