ফাইল ছবি
প্রতি বছর ১৬ই ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস এলেও, শিল্প ও বাণিজ্য নগরী নারায়ণগঞ্জের মাটি আজও বহন করে ১৯৭১ সালের নয় মাসের বিভীষিকাময় স্মৃতি। শীতলক্ষ্যা নদীর তীরবর্তী এই জনপদ কীভাবে পাক হানাদার বাহিনীর নৃশংসতা আর স্থানীয় প্রতিরোধের কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল, সেই রক্তক্ষয়ী ইতিহাস আজও প্রজন্মকে অনুপ্রেরণা যোগায়।
আক্রমণ ও প্রথম প্রতিরোধ
২৫শে মার্চের কালরাতের পর, দ্রুতই পাকবাহিনীর লক্ষ্যবস্তু হয় নারায়ণগঞ্জ। ঢাকা-চট্টগ্রাম সংযোগকারী কৌশলগত সড়ক ও রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং শীতলক্ষ্যার ডকইয়ার্ড তাদের কাছে ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ২৯শে মার্চের মধ্যে হানাদার বাহিনী শহরে প্রবেশ করে। কিন্তু তাদের ধারণা ছিল ভুল—তারা এখানে কোনও ফাঁকা মাঠ পায়নি। বরং ছাত্র-জনতা এবং স্থানীয় ইপিআর সদস্যদের নিয়ে গঠিত হয় স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ। ফতুল্লা, বন্দর এবং রূপগঞ্জের প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রাথমিক গেরিলা দলগুলো সংগঠিত হতে শুরু করে।
বধ্যভূমির নীরব সাক্ষী
যুদ্ধের সময় নারায়ণগঞ্জ শহর ও তার আশেপাশের এলাকাগুলো পরিণত হয়েছিল গণহত্যার কেন্দ্রে। বক্তাবলী সংলগ্ন অঞ্চলটিকে স্থানীয়ভাবে চিহ্নিত করা হয় প্রধান বধ্যভূমিগুলোর একটি হিসেবে। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, এখানে বহু নিরপরাধ মানুষকে ধরে এনে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল।
সাফল্যের আড়ালে আত্মত্যাগ
নারায়ণগঞ্জের ইতিহাসে সবচেয়ে সফল অপারেশনগুলোর মধ্যে রয়েছে কৌশলগত কয়েকটি হামলা। এই অপারেশনগুলো মূলত ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে এবং পাকবাহিনীর চলাচল ব্যাহত করতে সাহায্য করে। স্থানীয় মুক্তিকামী জনতা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গেরিলাদের খাবার সরবরাহ, লুকিয়ে রাখা এবং গুরুত্বপূর্ণ গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদানে সাহায্য করতেন। এটি প্রমাণ করে, মুক্তিযুদ্ধ কেবল সম্মুখ সমরের ঘটনা ছিল না, এটি ছিল গণমানুষের যুদ্ধ।
বিজয়ের উল্লাস
ডিসেম্বর মাসের শুরু থেকেই পাকবাহিনীর উপর চাপ বাড়তে থাকে। যৌথ আক্রমণে এবং স্থানীয় গেরিলা বাহিনীর তীব্রতায় হানাদাররা পিছু হটতে বাধ্য হয়। ১৫ই ডিসেম্বর রাত থেকেই শহরে বিজয়ের আভাস আসতে শুরু করে। ১৬ই ডিসেম্বরের সকালে নারায়ণগঞ্জের আকাশে যখন বিজয় নিশান উড়ল, তখন তা ছিল নয় মাসের ত্যাগের ফল। কিন্তু সেই বিজয় আজও বহু শহীদের রক্তের দাগ বহন করছে।

