মঙ্গলবার, ০৩ জুন ২০২৫

|

জ্যৈষ্ঠ ১৮ ১৪৩২

Advertisement
Narayanganj Post :: নারায়ণগঞ্জ পোস্ট

মহাকাশে পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটলে কী হবে?

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

প্রকাশিত: ১১:১৫, ১ জুন ২০২৫

মহাকাশে পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটলে কী হবে?

সংগৃহীত

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘গোল্ডেন ডোম’ প্রকল্প নিয়ে বিশ্বজুড়ে সমালোচনা শুরু হয়েছে। উত্তর কোরিয়া হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছে, এই মহাকাশভিত্তিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মহাকাশকে একটি সম্ভাব্য পারমাণবিক যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করতে পারে।

চীন এবং রাশিয়াও একইভাবে সতর্ক করেছে, এই ধরনের পদক্ষেপ প্রকৃতিকে গভীরভাবে অস্থিতিশীল করবে এবং মহাকাশে অস্ত্র প্রতিযোগিতার এক নতুন অধ্যায় শুরু করবে। ট্রাম্পের ঘোষণার পর, ২০২৯ সালের মধ্যে গোল্ডেন ডোম প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে সবার মনে প্রশ্ন জেগেছে, মহাকাশে যদি পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটে, তাহলে কী হবে?

পৃথিবীর বুকে পারমাণবিক বিস্ফোরণে যা ঘটে, তা মহাকাশে একেবারেই ঘটবে না। পৃথিবীতে বিস্ফোরণের ফলে বিশাল এক আগুনের গোলা, শকওয়েভ, তাপমাত্রার হঠাৎ পরিবর্তন, এবং মারাত্মক তেজস্ক্রিয়তা দেখা যায়। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে বিস্ফোরণস্থলের সবকিছু ধ্বংস হয়ে যায় এবং মাশরুমের মতো দেখতে মেঘ তৈরি হয়, যা দীর্ঘস্থায়ী তেজস্ক্রিয় বিকিরণ ছড়ায়। লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু ঘটে এবং এই প্রভাব কয়েক দশক ধরে স্থায়ী হতে পারে।  

কিন্তু মহাকাশের বাস্তবতা সম্পূর্ণ আলাদা। সেখানে বাতাসের অভাবে কোনো আগুনের গোলা বা মাশরুম মেঘ তৈরি হয় না। বরং বিস্ফোরণের সমস্ত শক্তি তীব্র ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক বিকিরণ (ইএমপি) হিসেবে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এই ইএমপির মধ্যে থাকে গামা রশ্মি, এক্স-রে, এবং উচ্চ চার্জযুক্ত কণিকা, যা আশেপাশের সমস্ত উপগ্রহ ও বৈদ্যুতিন যন্ত্রপাতিকে মুহূর্তেই ধ্বংস করে দিতে পারে। এমনকি এই উচ্চ চার্জযুক্ত কণিকাগুলো বছরের পর বছর ধরে পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রের কক্ষপথে ঘুরতে থাকে, ফলে উপগ্রহগুলোর ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতির ক্ষতি হতে থাকে।

১৯৬২ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘স্টারফিশ প্রাইম’ নামে এক নিয়ন্ত্রিত মহাকাশ পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটায়। এই বিস্ফোরণটি হাওয়াইয়ের উপরে ২৫০ মাইল উচ্চতায় ঘটানো হয়, যা আজকের দিনের অনেক স্যাটেলাইটের নিম্নকক্ষপথের সমতুল্য। বিস্ফোরণের পর প্রশান্ত মহাসাগরের উপর দিয়ে একটি তীব্র বৈদ্যুতিক স্রোত ছড়িয়ে পড়ে, যার ফলে হাওয়াইয়ের ওহু দ্বীপের প্রায় ৩০০টি রাস্তার আলো একসঙ্গে নিভে যায়। সেই সময় পৃথিবীর কক্ষপথে প্রায় ২৪টি উপগ্রহ ছিল, যার মধ্যে আটটি পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়। বিস্ফোরণের ফলে হাওয়াইয়ের আকাশে উত্তর মেরুর মতো রঙিন আলোর ঝলকানি দেখা দেয়। সেই রাতে আকাশে সবুজ, তারপর হলুদ, এবং শেষে কমলা রঙের আলো দিনের মতো উজ্জ্বল হজয়ে উঠেছিল।

স্টারফিশ প্রাইমের এই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার পর ১৯৬৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন মহাকাশ চুক্তি স্বাক্ষর করে, যেখানে পৃথিবীর কক্ষপথে গণবিধ্বংসী অস্ত্র মোতায়েন নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু ষাট বছর পরও এই শিক্ষা যেন বিস্মৃতির গহ্বরে হারিয়ে যাচ্ছে। গোল্ডেন ডোম প্রকল্প ও মহাকাশ প্রতিরক্ষা উদ্যোগ নতুন করে মহাকাশে পারমাণবিক যুদ্ধের আশঙ্কা তৈরি করেছে।

বর্তমানে পৃথিবীর কক্ষপথে দশ হাজারেরও বেশি উপগ্রহ রয়েছে, যা মানুষের যোগাযোগ, ইন্টারনেট, আবহাওয়ার পূর্বাভাস, ন্যাভিগেশন (জিপিএস), এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণার ওপর নির্ভর করে চলছে। একটি মহাকাশ পারমাণবিক বিস্ফোরণ এই স্যাটেলাইটগুলোকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিতে পারে। ইএমপির প্রভাবে পুরো পৃথিবীর বিদ্যুৎ, যোগাযোগ, এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বিপর্যস্ত হতে পারে। পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রের বিকৃতি ঘটতে পারে, যা তীব্র সৌর ঝড়ের মতো প্রলয়কর প্রভাব ফেলতে পারে। এতে শুধু প্রযুক্তিগত বা সামরিক বিপর্যয় নয়, বরং মানব সভ্যতার একটি বড় অংশ চরম সঙ্কটে পড়তে পারে।

চীন সতর্ক করে বলেছে, মহাকাশে পারমাণবিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা প্রকৃতিকে অস্থিতিশীল করবে এবং অস্ত্র প্রতিযোগিতাকে উসকে দেবে। উত্তর কোরিয়াও হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছে, মহাকাশকে যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করা হলে তার ফলাফল ভয়াবহ হতে পারে। এমন এক সময়ে যখন প্রযুক্তি ও শান্তির দিকে এগিয়ে যাওয়া জরুরি, তখন মহাকাশে পারমাণবিক বিস্ফোরণ নিয়ে এই পরিকল্পনা মানবজাতিকে এক অনিশ্চিত, বিপজ্জনক ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।